এটম সমাচার,গল্পে গল্পে অণু পরমাণু,সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী,About Atom,S K S Hazari |
এটম সমাচার - গল্পে গল্পে অণু পরমাণু – ১ - সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী - About Atom – S K S Hazari
আমাদের বাড়ীতে একটি গ্রামোফোন আছে। এটি চলে, কিন্তু চলে না। অর্থাৎ এটি চালু থাকলেও বর্তমানে কেউ চালায় না। প্রথমে রেডিও, তারপর টেলিভিশন ও ভিসিডির দাপটে এটি এখন ঐতিহাসিক নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। তবে ছেলেবেলায় এতে অনেক গান শুনেছি। একা নয়, এটি চালানো হলে সাথে সাথে পাড়ার ছেলেমেয়েরা গান শুনার জন্য ছুটে আসতো। অনেক গানের ভীড়ে একটি ব্যতিক্রমধর্মী গানের কথা মনে পড়ে। গানটির প্রথম দুটো লাইন হচ্ছে
“এটম বোমার গল্প শুনে।
হার্টফেল করে বৌটা গেছে মরে।”
এরপর আছে বাচ্চার কান্নার বিবরণ ইত্যাদি। স্ত্রীর মৃত্যুতে গায়ক কতটা ব্যথিত, বাচ্চার কান্নায় গায়ক কতটা বিচলিত নাকি এ অজুহাতে গায়ক শীঘ্র আরেকবার পাণিগ্রহণে ব্যস্ত- সে সকল প্রশ্ন তখন মাথায় আসেনি। এসেছে শুধু এটমের কথা। ভেবেছি এটম না জানি কি বিরাট ও ভয়ংকর বস্তু, যার গল্প শুনেই লোক মারা যায়। তখন রূপকথার দৈত্য দানোর গল্প শুনেছি; ধরে নিয়েছি এটম বিরাট দৈত্য দানোর মত হবে।
তোমরা হাসছো? হাসবেই তো। কেননা তোমরা এটম সম্পর্কে এখন অনেক কিছু জানো। জানো যে এটম অত্যন্ত ক্ষুদ্র! তোমরা এও জানো যে পৃথিবীর সকল বস্তু এটম দ্বারা গঠিত। সুতরাং তোমাদের শরীর, কাপড় চোপড় সবকিছু অসংখ্য এটম দ্বারা গঠিত। খেতে বসে তোমরা পোলাও, বিরিয়ানী বা ডাল-ভাত যাই খাওনা কেন, প্রকৃত অর্থে তোমরা অসংখ্য এটম খাচ্ছ। এমনকি শ্বাস নেওয়ার সময় অসংখ্য এটম তোমাদের শরীরে প্রবেশ করছে আর শ্বাস ফেলার সময় অসংখ্য এটম বের হয়ে যাচ্ছে। তোমরা এটম সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানো। জানা প্রয়োজন। কেননা এটম যতই ক্ষুদ্র ও নিরীহ মনে হোক না কেন, এর ভিতর যে প্রচন্ড শক্তি লুকিয়ে আছে, তা দিয়ে পৃথিবীর যেমন অনেক কল্যাণ করা যায় তেমনি সমগ্র পৃথিবীকে নিমিষে ধ্বংস করা যায়। এটমকে যে আমি বিরাট দৈত্য দানো বলে মনে করতাম, প্রকৃতপক্ষে তা একেবারে ভুল নয়। পার্থক্য এই যে, এটমের শক্তির তুলনায় এ সকল দৈত্যদানোর শক্তি একেবারেই নগণ্য। প্রকৃতপক্ষে এটমের শক্তি কিভাবে ব্যবহৃত হবে, তার উপরই নির্ভর করছে সমগ্র মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ। যা হোক এটম সম্পর্কে যেহেতু সবার জানা উচিৎ এবং যেহেতু তোমরা অনেক কিছু জান, তাহলে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক- তোমরা কতটুকু জানো?
প্রথমেই বল দেখি- এটমের বাংলা অনুবাদ কি? হ্যা তোমরা সবাই জান- এটমের বাংলা হচ্ছে পরমাণু। তবে তা অনেকেই জানে না। যেমন এখনো পত্রিকায় মাঝে মাঝেই দেখা যায় atomic bomb এর বাংলা অনুবাদ লেখা হচ্ছে আণবিক বোমা। হবে পারমাণবিক বোমা (সত্যিকার অর্থে বলা উচিৎ nuclear bomb বা নিউক্লীয় বোমা)। এমনকি বাংলাদেশে এটম সংক্রান্ত সকল ভার যাদের উপরে সেই Bangladesh Atomic Energy Commission নিজের নামের বাংলা অনুবাদ করেছিল বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন। এখন অবশ্য তা শুদ্ধ করা হয়েছে; তবে কিছুদিন আগেও দেখেছি তাদের কর্মচারীদের একটি বাসে পুরানো নাম রয়ে গেছে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখি Bangladesh Institute for Nuclear Studies (BINA) নিজ নামের অনুবাদে "nuclear" এর অর্থ করেছে “আণবিক”। বাহ্, এ নাহলে বিশেষ-অজ্ঞ।
এখন বল দেখি “পরমাণু” শব্দটির তাৎপর্য কি? ও উৎপত্তি কিভাবে? এটি বোধ হয়। একটু কঠিন। তাই আমিই বলে দিচ্ছি -“অণু” শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র। পরম + অণু = পরমাণু। সুতরাং পরমাণু শব্দটির অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্রতম।
আমরা যে কোন বস্তুকে ভেঙ্গে ফেলতে পারি। যে কোন একটি ভগ্নাংশ নিয়ে আরো ক্ষুদ্র করতে পারি। প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কি আমরা ক্রমাগত ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র অংশ তৈরী করতে পারবো নাকি এক জায়গায় এসে দাঁড়াবে যখন আর ভাঙ্গা যাচ্ছে না। প্রথমক্ষেত্রে হবে পদার্থ নিরবচ্ছিন্ন (continuous) আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পদার্থ বিচ্ছিন্ন (discrete) কণাসমূহের সমষ্টি। প্রকৃতপক্ষে যে কোন পদার্থকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একটি ক্ষুদ্র অংশে পৌছানো যায়, যার নাম হচ্ছে অণু। এর মধ্যে পদার্থের সকল গুণ বিদ্যমান। অণুকে আরো ভাঙ্গলে পাওয়া যায় বিভিন্ন পরমাণু; তবে তার মধ্যে আর পদার্থের গুণ বিদ্যমান থাকে না। ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে বহু হাজার বৎসর আগে পরমাণু মতবাদের উদ্ভব হয়; কিন্তু তা কেবল দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তখন সম্ভব ছিলো না।
প্রাচীন গ্রীসে আজ থেকে প্রায় ২৫০০ হাজার বৎসর আগে পরমাণু মতবাদের উদ্ভব ঘটে। Leucippus ও তার ছাত্র Democritus এ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সকল পদার্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবিভাজ্য অংশ দ্বারা গঠিত। ডেমোক্রিটাস এই অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম অংশের নাম দেন atoma। শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ হতে উদ্ভূত- a (not) এবং temnein (to cut)। অর্থাৎ atoma বলতে বুঝায় যা আর বিভাজ্য নয়। কিন্তু বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক Aristotle এর প্রভাবে এ মতবাদ চাপা পড়ে যায়। অ্যারিষ্টটলের মতে পদার্থ নিরবচ্ছিন্ন, তাকে যত ইচ্ছা ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে atom মতবাদ আবার বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের সমর্থন লাভ করে। অবশেষে বৃটিশ স্কুল শিক্ষক John Dalton এই মতবাদকে বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
এখন বল দেখি- পরমাণুসমূহ কত বড়?
খুব ছোট?
তাতো বটেই। কিন্তু এদের ব্যাস বা ব্যাসার্ধ মাপার একক কি?
কি বললে?
দৈর্ঘ্যের একক। তাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু দৈর্ঘের অনেক একক আছে, যা আমরা পরিমাণ অনুযায়ী ব্যবহার করি। যেমন চট্টগ্রাম হতে ঢাকার দূরত্ব জিজ্ঞাসা করলে বল এতো কিলোমিটার; নিশ্চয়ই বলো না এত কোটি সেন্টিমিটার। অন্যদিকে কাপড় কিনতে গেলে মিটার হিসাবে কিন। তোমার হাতের পেন্সিল কত লম্বা বলতে সেন্টিমিটার একক ব্যবহার কর। পরমাণুসমূহের আকার মাপতে যে একক ব্যবহৃত হয়, তা হচ্ছে আংষ্ট্রম। 1A = 10-8cm। দশের উপর শক্তিমাত্রা দেওয়ার একটি সুবিধা হচ্ছে এই যে, এভাবে অনেক বড় বা ছোট সংখ্যা সহজে লিখা যায়। তবে অসুবিধা হচ্ছে এদ্বারা ঠিক বুঝা যায় না পরিমাপটি প্রকৃতপক্ষে কত ছোট বা বড়। আমরা একটি উদাহরণ। দ্বারা পরমাণুর আকার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।
হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাসার্ধ প্রায় 0.5A অর্থাৎ এর ব্যাস 1A । আমরা যদি একটি খুবই শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরী করতে পারতাম, তাহলে পরমাণুগুলিকে মার্বেলের মতো মনে হতো। এ রকম 108 বা দশ কোটি পরমাণু পাশাপাশি রাখলে তার দৈর্ঘ্য হবে 10-8 X 108= 1cmসুতরাং, দশ কোটি পরমাণু = ১ সে.মি.
এটি একটি সুতার মত হবে, যার দৈর্ঘ এক সে.মি., কিন্তু তা 1A পুরু হওয়ায় একে খালি চোখে দেখা যাবে না। আমরা যদি এরকম দশ কোটি সুতা পাশাপাশি রাখি, তবে। আমরা এক বর্গ সেন্টিমিটার ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কাগজের ন্যায় হবে, যা 1A পুরু হওয়ায় চোখে দেখা যাবে না; কিন্তু এতে 108x108=1016 টি পরমাণু বিদ্যমান।
এ ধরনের দশকোটি তল একটির উপর একটি রাখলে একটি ঘনকের সৃষ্টি হবে, যা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় ১ সে. মি. বলে তার আয়তন হবে ১ ঘন সে.মি. বা ১ সি. সি.। এটি তখন দেখা যাবে এবং এতে আছে 1016x108=1024 টি পরমাণু। অন্য কথায় ১ সি.সি, পরিমাণ স্থানে 1024 টি হাইড্রোজেন পরমাণু রাখা যাবে।
১ সে.মি. চিত্র - দশ কোটি তলকে একটির উপর
একটি রাখলে ১ সি.সি. আয়তন বিশিষ্ট একটি ঘনক সৃষ্টি হবে। (এ ছবিতে সত্যিকার আকার দেখানো
হয়েছে।)
কি বললে, খালি চোখে দেখা যাবে না?
হয়তো যাবে, একটি সূক্ষ ধুলিকণার ন্যায়। কিন্তু এতে 1024÷108=1016 টি পরমাণু আছে। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা কত জানো! ১৬ কোটি? ১৮ কোটি? আমার হিসাবের সুবিধার জন্য দশ কোটি ধরা যাক। মনে করি আমাদের হাতে একটি খুবই ভালো অণুবীক্ষণ যন্ত্র আছে যা দিয়ে যত গুণ ইচ্ছা বড় করে দেখা যায়। এ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে সূক্ষ বালুকণাটি নিয়ে তাতে যে পরমাণু আছে, তা যদি বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেই, তবে তোমার ভাগে পড়বে 1016-108 = 108 অর্থাৎ দশ কোটি পরমাণু। এগুলি গুণতেই তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ একটি সূক্ষ ধূলিকণাতে যতসংখ্যক পরমাণু আছে, তা গুণতে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের জীবন শেষ হয়ে যাবে। এখন আশা করি বুঝতে পারছো পরমাণু কতটা ক্ষুদ্র। অন্যান্য পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণু অপেক্ষা কিছুটা বড়; ফলে সে ক্ষেত্রে পরমাণুর সংখ্যা কিছুটা কম হবে; তবে তাতে আমার মূল বক্তব্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
পরমাণুসমূহ এতো ক্ষুদ্র হতে পারে; তা বলে কিন্তু এরা তুচ্ছ নয়। কেননা সমগ্র বস্তুজগত তো পরমাণু দ্বারাই সৃষ্ট। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির বিন্দু যেমন একত্রিত হয়ে মহাসমুদ্র সৃষ্টি করে, তেমনি অনেক অনেক ক্ষুদ্র পরমাণু একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বস্তু সৃষ্টি করে। আবার অন্যদিকে পরমাণুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রচন্ড শক্তি, যা পারমাণবিক শক্তি নামে পরিচিত। এর কথা অন্য দিন বলা হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন