গল্পে গল্পে অণু ও পরমাণু, সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী, Story of Atoms and Molecules,S K S Hazari |
বসুন ও রসুনের কাহিনী - গল্পে গল্পে অণু ও পরমাণু – ৩ – এস কে এস হাজারী – Bosun and Rosuner kahini - Story of Atoms and Molecules – 3 – S K S Hazari
ভোলানাথ আমাদের পাড়াতেই থাকে। তার একটা পিতৃপ্রদত্ত নাম আছে, কিন্তু তা এ নামের আড়ালে চলে গেছে। তার একটি দোষ হচ্ছে সে যা পড়ে, তা সহজে ভুলে যায়। রসায়ন এর ক্লাসে সে তার দোষ চাপাল বিষয়ের উপরে। বললো Chemistry হচ্ছে easy to learn, easy to forget, রসায়ন সহজে শেখা যায়, সহজে ভোলা যায়। শিক্ষক বললেন, না বুঝে মুখস্থ করলে তো ভোলানাথ হতেই হবে। এ ঘটনা থেকেই তার এ নতুন নাম চালু। আজকের কাহিনী ভোলানাথকে নিয়েই।
টেষ্ট পরীক্ষা হবে। ফাইনাল পরীক্ষা যে পরিবেশে হোক না কেন, এতোদিন টেষ্ট পরীক্ষা ভালো মতোই হতো। কিন্তু ভোলানাথরা পরামর্শ করলো, সত্যিকার নাটকের আগে যেমন রিহার্সাল হয়, ফাইনাল পরীক্ষার আগে টেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে সেরূপ, সুতরাং টেষ্ট পরীক্ষাও ফ্রি ষ্টাইলে হওয়া উচিত। হলোও তাই। ভোলানাথ একজন ভালো ছাত্রের খাতা দেখে দেখে সব লিখে আসলো। কিন্তু পরীক্ষার ফল দেখে তো তার চোখ কপালে। সে ছেলেটি খুব ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেছে, আর সে ফেল। একই লেখা হওয়া সত্ত্বেও এতবড় পার্থক্য। অবিচার আর কাকে বলে! যা হোক মনের রাগ চেপে রেখে সে শিক্ষকের সাথে দেখা করলো। শিক্ষক পরীক্ষার খাতা খুলেই প্রথমে দেখালেন যে ভোলানাথ লিখেছে।
Na2Co3 + 2HCl = 2NaCl + Co2 + H2O
এজন্য সেখানে শূন্য দেওয়া হয়েছে। ভোলানাথ দেখালো অপর ছাত্র একই কথা লিখে। পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। সেখানে লেখা
Na2CO3 + 2HCl = 2NaCl + CO2 + H20
শিক্ষক ব্যাখ্যা দিলেন সোডিয়াম কার্বনেটের সংকেত হচ্ছে Na2CO3; অর্থাৎ তার অণুতে দুটো সোডিয়াম, একটি কার্বন ও তিনটি অক্সিজেন পরমাণু আছে। অপরদিকে ভোলানাথের লেখা Na2Co3 এর অর্থ হচ্ছে এমন একটি যৌগ, যার অণুতে দুটো সোডিয়াম এবং তিনটি কোবাল্ট পরমাণু বিদ্যমান। এছাড়া ক্লোরিনের সংকেত লেখার সময় C ছোট হাতের হয়ে গেছে, এর ফলে যা লেখা হয়েছে, তার কোন অর্থ হয় না। একটু পরেই সোডিয়াম ফসফেটের সঠিক সংকেত Na3PO4 এর স্থলে লেখা হয়েছে Na3Po4 যা দ্বারা এমন একটি অণু বুঝায় যাতে তিনটি সোডিয়াম এবং চারটি পোলোনিয়াম পরমাণু বিদ্যমান। কপারের প্রতীক লেখা হয়েছে CU, যা দ্বারা ইউরেনিয়াম কার্বাইড জাতীয় কিছু বুঝা যায়।
ভোলানাথ যুক্তি দেখালো, এই যে ছোট বড় হাতের লেখা, কিঞ্চিৎ পার্থক্যের জন্য সমগ্র খাতায় সর্বোচ্চ হলে দুয়েক নম্বর কাটা যায়।
তখন শিক্ষক একটি গল্প বললেন, “একজন লোক সবেমাত্র লেখাপড়া লিখেছে। তার বাড়ীতে একজন সাহেব এসেছে। সে ভাবল ইংরেজিতে কথা বলে তাকে চমকে দিবে। লোকটি ডিকশনারী দেখে এসে সাহেবকে বললো, garlic sir, garlic sir! সাহেব তো এদিকে রসুন খুঁজে পায় না। আসলে লোকটি ডিকশনারীতে বসুন শব্দটি দেখতে যেয়ে রসুনের প্রতিশব্দ দেখে এসেছে। বসুন আর রসুন এদের লেখার মধ্যে মাত্র একটি বিন্দুর পার্থক্য, কিন্তু সত্যিকার পার্থক্য অনেক।
বাংলাভাষায় যেমন অ, আ, ক, খ ইংরেজীতে যেমন A, B, C, D ঠিক। তেমনি এ সকল প্রতীক ও সংকেত রসায়নে বর্ণমালার মতো কাজ করে। অ, আ, ঠিকমতো না শিখলে যেমন বাংলাভাষা শিখা যায় না, তেমনি রসায়নের এ সকল প্রতীক ও সংকেত ঠিকমতো না শিখলে রসায়ন শিখা সম্ভব নয়। বরঞ্চ এক কথা বলতে যেয়ে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলা হয়ে যাবে। ধরো, তুমি সাধারণ কপার (তামা) দিয়ে কোন কাজ করলে আর রিপোর্ট লেখার সময় CU লিখলে আর সে রিপোর্ট কোন বিদেশীর নজরে আসলো, সে তখন ধরে নেবে তুমি ই*উ*রে*নি*য়া*ম ও কপারের কোন যৌগ নিয়ে কোন কাজ করছে। অথবা কপার বা কপারের যৌগ বিদেশ হতে আমদানী করার সময় একই ভুল করলে ই*উ*রে*নি*য়া*মের জন্যে শুধু অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য চাওয়া হবে না, এ তথ্যটি আ*ন্ত*র্জা*তি*ক পা*র*মা*ণ*বি*ক শ*ক্তি ক*মি*শ*নে জানিয়ে দেওয়া হবে। উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উপর নির্দেশ আসবে এ*ট*ম বো*মা তৈরীর চেষ্টার দায়ে তোমাকে যেন তৎক্ষণাৎ গ্রে*ফতার করা হয়, নতুবা বাংলা*দেশের বি*রু*দ্ধে সা*ম*রি*ক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেচারা ভোলানাথ কি বলবে!
পরের পৃষ্ঠা উল্টালো, সেখানে লেখা Na11, শিক্ষক সেটি কেটে দিয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন কোন মৌলের প্রতীকের ডানদিকের নীচের কোণায় যে সংখ্যা লেখা হয়, তা দ্বারা সে মৌলের ততটি পরমাণু যৌগের একটি অণুতে অবস্থিত, একথা বুঝায়। যেমন O2 দ্বারা বুঝায় দুটি অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা গঠিত অণু। H2SO4 সংকেত দ্বারা বুঝায় এর একটি অণুতে দুটো হাইড্রোজেন, একটি সালফার ও চারটি অক্সিজেন পরমাণু বিদ্যমান। সুতরাং Na11 দ্বারা বুঝায় এমন একটি অণু যেখানে ১১টি সোডিয়াম পরমাণু বিদ্যমান। অথচ ভোলানাথ বোধহয় বুঝাতে চেয়েছে যে সোডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ১১। সেক্ষেত্রে 11Na বা অন্তত Na(11) লেখা উচিত ছিলো।
ভোলানাথও কম যায়না। ২/৩ দিন পরে একটি বই নিয়ে আসলো যেখানে Na11 লেখা আছে। শিক্ষকের উত্তর-ছাপার কারণে হোক বা লেখকের অজ্ঞতার কারণে হোক এ ধরণের ভুল বইতে থাকা অসম্ভব নয়। এ ধরণের একটি ভুলের উদাহরণ দিয়ে ভুল উত্তরের জন্য নম্বর পাওয়া যায় না। বিশেষতঃ টেষ্টের ক্ষেত্রে না হয় পরীক্ষককে বলা গেল, ফাইনাল পরীক্ষায় তো বলা সম্ভব হবে না। সুতরাং ছাত্রদের উচিৎ সত্যিকার নিয়মগুলি জেনে নেওয়া এবং কোনরূপ সন্দেহ হলে শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করা এবং আরো দু’তিনটি বই দেখা। কয়েকটি বইতে একই ভুল থাকার সম্ভাবনা খুব কম।
ভোলানাথের খাতায় এর পরের পৃষ্ঠায় লেখা
এখানেও নম্বর শূণ্য। শিক্ষক ভোলানাথকে কি লেখা আছে পড়তে বলায় সে পড়লো P plus A by V square । শিক্ষক ভোলানাথকে square এর সংকেত কিভাবে লিখে জিজ্ঞাসা। করার যে ক্রমান্বয়ে P,v,V প্রভৃতি অনেক কিছু লিখলো। শিক্ষক বললেন square এর অর্থ power 2, সুতরাং লিখতে হবে।
ভোলানাথ তখন বললো, “এটি আমার লেখার ষ্টাইল।”
শিক্ষক বললেন “পোষ্টার লেখার সময় তোমার ইচ্ছামতো ষ্টাইল চালাও। অন্য ক্ষেত্রে চালানো যায় না। যেমন চেকে যদি তুমি ১০৪ লেখ, আর ব্যাংকে যেয়ে দশ হাজার টাকা দাবী করো, তখন কি তুমি দশ হাজার টাকা পাবে?”
ভোলানাথ বললো, “না, স্যার, ব্যাংকের লোকেরা অত বোকা নয়।
শিক্ষক বললেন, “তুমি তো বলতে পার ১০৪ দ্বারা তুমি ১০৪ বা ১০০০০ বুঝাতে চেয়েছ।”
ভোলানাথ বললো “ব্যাংকের লোকেরা তা মানবে না। তারা নিয়মের বাইরে যায় না।”
শিক্ষক বললেন “তাহলে আমাদের এতো বোকা ভাবছ কেন, যে নিয়মের বাইরে লিখলেও তোমাদের নম্বর দেব।”
ভোলানাথ কিন্তু নাছোড়বান্দা, তার খাতায় কিছু নম্বর বাড়িয়ে দিতেই হবে। শিক্ষক অবশেষে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তোমাকে পুরো একশত নম্বরই দেব।”
ভোলানাথের তো আনন্দে হার্টফেল করার মতো অবস্থা। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু শিক্ষকের পরের কথাগুলি শুনে সে চুপসে গেল, “অবশ্য সে নম্বর লেখা হবে আমার বিশেষ ষ্টাইলে, একশত নম্বরকে লিখব ০। যিনি সব নম্বর যোগ করবেন, তিনি বুঝতে পারলে একশত নম্বরই যোগ হবে।”
ভোলানাথের গল্পটি তোমাদের শুনানোর বিশেষ কারণ আছে। তোমাদের লেখা রসায়নের ফর্মুলা ইত্যাদি দেখে আমার মনে হয়, তোমাদের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছে ভোলানাথ। এ সব লেখার সময় যত্নবান থাক না, ফলে কি লিখতে যেয়ে কি লিখে এসেছ, তা বুঝতেই পার না। আর তোমাদের পাশ করাতে আমাদের হয় কষ্ট। আর একটা অবিশ্বাস্য কথা বলি। তোমরা ইংরেজীতে যতই জ্ঞানী হওনা কেন, যতই V-চ্যানেল দেখনা কেন, ইংরেজী ছোট বড় হাতের অক্ষর কোনটি কোন মাপের হবে তা তোমরা অনেকেই জানোনা। যে কারণে অনেক সময় রসায়নের নিয়ম জেনেও এ মাপ না জানায় কার্বন মনোক্সাইডের সংকেত লিখ Co, কোবাল্টের সংকেত CO। শিশুশিক্ষা জাতীয় বই দেখে শিখে নিও। এতে লজ্জার কিছু নেই। ক্রমাগত ভুল লিখে যাওয়া অনেক বেশী লজ্জার। তোমাদের জন্য সোডিয়াম ক্লোরাইড, মারকিউরাস ক্লোরাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও কোবাল্ট কার্বনেটের সংকেত লিখে দিলাম।
NaCl, Hg2Cl2, CO, CoCO3
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন