স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর ছেলেবেলা,Sir Jagdish Chandra Bose |
বাবা
ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার বন্ধুদের ছেলেরা সকলে ইংরেজি স্কুলে পড়ে। তাদের
মতো অভিজাত পরিবারের ছেলেরা ইংরেজি স্কুলে পড়ে, কিন্তু সে পড়াশোনা
করে বাংলা স্কুলে। ছেলেটির বাবা যখন ফরিদপুরে চাকরি করছেন, তখন
ওই শহরে একটিমাত্র জেলা স্কুল। এই স্কুলে সকলের পড়ার সুযোগ নেই। স্কুলে জায়গা
না-পেয়ে ওই শহরের অনেক ছেলেরা ছেলেটির বাবাকে ধরল একটা বাংলা স্কুল খুলতে। তিনি
শুধু স্কুল খোলার ব্যবস্থাই যে করলেন তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে
ছেলেকে পাঠালেন ওই স্কুলে পড়বার জন্য। স্কুলে ছেলেটির সহপাঠীদের মধ্যে ডানদিকে
বসে বাবার মুসলমান চাপরাশির ছেলে আর বাঁ-দিকে একজন ধীবরের ছেলে। তাদের সঙ্গে
ছেলেটি শুধু লেখাপড়া আর খেলাধুলোই করে না, অবসর সময়ে
পশুপাখি জীবজন্তুদের সম্বন্ধেও তাদের কাছে অনেক গল্প শোনে। শুনতে শুনতে তার বিস্ময়ের শেষ থাকে না।
স্কুলের
আসা-যাওয়ার পথের ধারে নানারকমের গাছপালা, বনজঙ্গল দেখে সে। এরকম
একদিন সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুল যাওয়ার পথে এক বন্ধু বলে উঠল, “একটা মজা
দেখবি?”
বন্ধুটি
লজ্জাবতী লতার বনে একটা গাছকে ছুঁয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতা কুঁকড়ে
গিয়ে নুয়ে পড়ল। গাছটা যেন সত্যি সত্যি লজ্জায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
অবাক
হয়ে গেল ছেলেটি। ফেরার পথে গাছের পাতা ছুঁতেই আবার একই কাণ্ড। বাড়ি গিয়ে
রাত্রিতে বাবার কাছে ঘটনাটা বলল। বাবা কিছু বললেন না, শুধু
শুনলেন।
পরের
দিন যাওয়ার সময় দেখল গাছের পাতা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। কিন্তু ছুঁয়ে দিতেই একই
ঘটনা। দিনের পর দিন একই ঘটনা ঘটে। বালকের মনে কৌতূহল জাগে। কেন এরকম হয়?
বাবা
অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সন্ধেবেলায় বাড়ি আসেন ক্লান্ত হয়ে। তবু তার
মধ্যে খাওয়া দাওয়া সেরে রাত্রিবেলায় ছেলের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। ছেলে
বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “বাবা, বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছের
পাতা ছুঁয়ে দিলে তাদের ডালপালা সবকিছু নিচু হয়ে যায় কিন্তু আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল ইত্যাদি
গাছকে ছুঁলে সেসব গাছের তো কিছু হয় না।”
বাবা
ছেলের কৌতুহল দেখে অবাক হয়ে যান। বলেন, “আম, জাম,
কাঁঠাল, নারকেল সাড়া দেয় কি না তা আমাদের
জানা নেই। প্রকৃতির সব রহস্য তো আমরা জানতে পারি নি। তবে মানুষকে আঘাত করলে তার
যেমন লাগে, যেভাবে তার কষ্ট হয়, চোখ
দিয়ে জল পড়ে; গাছপালাও তেমনই, আঘাত
পেলে তাদের লাগে। আমগাছ, সজনেগাছের গায়ে কুড়াল দিয়ে
দু-কোপ বসিয়ে দাও, দেখবে সেই কাটা জায়গা থেকে আঠা বেরোচ্ছে।
সেটাই তাদের চোখের জল।” বাবার কথা শুনে ছেলেটির মনে
আরও আগ্রহ বেড়ে যায়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সে। অনেক কথার
উত্তর দিতেন ছেলেটির বাবা, আর কখনো কখনো বলতেন, “প্রকৃতির
অনেক কথা আমরা জানি না। তুমি বড় হয়ে জানবার চেষ্টা কোরো।” গল্প শুনতে শুনতে রাত বেড়ে যেত। ঘুমহীন ছেলেটির দু-চোখে
অবাক বিস্ময়। দাদিমা আর থাকতে না-পেরে তেড়ে আসেন নাতির দিকে। তিনি বলতে থাকেন,
“ছেলেটাকে মেরে ফেলবি নাকি? ঘুমিয়ে পড়, নইলে এই লাঠি দিয়ে মারব।” দাদিমার কথায়
ঘুমিয়ে পড়লেও ছেলেটির জানার আগ্রহ কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি।
সেদিনের
সেই ছেলেটি পরে মস্তবড় বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। বড় হয়ে অনেককিছু জেনেছিলেন আর
সারাবিশ্বের মানুষকে জানিয়েছিলেন যে গাছেরও প্রাণ আছে। এই ছেলেটিই প্রাতঃস্মরণীয়
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন