আবিষ্কারের গল্প,চিকেন কলেরার প্রতিষেধক টিকা, লুই পাস্তুর,The discovery of Chicken Cholera vaccine,Louis Pasteur |
আবিষ্কারের গল্প –চিকেন কলেরার প্রতিষেধক টিকা ও লুই পাস্তুর - The discovery of Chicken Cholera vaccine by Louis Pasteur
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
‘Chance only favours the prepared mind’ -Louis Pasteur
ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (Louis Pasteur, 1822--1895) বলেছিলেন, অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু পাওয়ার সৌভাগ্যটাও নির্ভর করে মানসিক প্রস্তুতির ওপর। আকস্মিক বা হঠাৎ করে একটা কিছু আবিষ্কার করতে হলেও কোনো না কোনো একটা গবেষণার কাজে লিপ্ত থাকতে হবে তোমাকে, অন্যথায় নয়। লুই পাস্তুর তাঁর জীবনে বেশ কিছু অমূল্য আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু যে চিকেন কলেরার আবিষ্কারের কাহিনী এখানে বলছি, সেটি তাঁর এক অন্যতম মহান আবিষ্কার হলেও এটি ছিল একটি আকস্মিক আবিষ্কার। সংক্রামক ব্যাধির কারণ যে জীবাণু, তাঁর ও রবাট কক নামক একজন ডাক্তারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় যখন প্রতিষ্ঠিত হলো তখন তিনি এসব রোগকে কি করে প্রতিরোধ করা যায়, নিরাময় করা যায়, সে সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন, আর তখনই অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের ফলে মানুষ আজ আরো কতকগুলি মারাত্মক রোগের শিকার হচ্ছে না, বিশেষ করে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে বহুগুণে। যেসব রোগে এককালে হাজার হাজার শিশু অকালে মরেছে—ঝরে গেছে, তেমনটি আর মরে না আজকালের শিশুরা।
আবিষ্কারের ব্যাপারে এই সত্য কথাটাই পাস্তুর বলেছিলেন তাঁর ঐ চিকেন কলেরার টিকা আবিষ্কারের সূত্রে, তাঁর আগেকার আবিষ্কারগুলির অভিজ্ঞার আলোকে! পাস্তুর যদি অন্যান্য আবিষ্কারগুলি নাও করতেন তবুও এই আকস্মিক আবিষ্কারটিই তাঁকে চির স্মরণীয় করে রাখতো চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে। এমনই অমূল্য, এমনই যুগান্তকারী ছিল তাঁর এই আবিষ্কারটি। অথচ মজার কথা হলো, তিনি নিজে কোনো ডাক্তার বা চিকিৎসক ছিলেন না, ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের একজন শিক্ষক। কিন্তু ঘটনা চক্রে এবং আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে, তিনি জীব বিজ্ঞানের এমন সব জটিল বিষয়ে জড়িয়ে পড়েন, আর একের পর এক এমন সব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন, যেগুলি মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধন করেছে। তাকে বলা হয় জীবাণুতত্ত্বের জনক। কতকগুলি রোগের কারণ যে কোনো কোনো বিশেষ ধরনের জীবাণু, এই যুগান্তকারী আবিষ্কার পাস্তুরের এক অমূল্য অবদান। এই আবিষ্কারের ফলে আজ অনেক দুরারোগ্য রোগকে দমন করা সম্ভব হয়েছে—সম্ভব হয়েছে পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন-এর মতো আশ্চর্য অ্যান্টিবায়োটিক, অনেক মারাত্মক ও দুরারোগ্য ব্যাধির বিরুদ্ধে অমোঘ ঔষধ। চিকেন কলেরার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের সুত্রে তিনি যে মূল সূত্রটির সন্ধান পান, সেই সূত্র ধরেই যেমন তিনি নিজে আবিষ্কার করেন অ্যানথ্রাক্স ও বিশ্ববিখ্যাত হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক রোগের টিকা তেমমি তাদেরই পথ ধরে পরবতীকালে আমরা পেয়েছি ‘ডি-পি-টি’ (D.P.T.), ডিপথেরিয়া, হুপিংকফ, টিটেনাস রোগের প্রতিষেধক টিকা ও যক্ষার প্রতিষেধক টিকা বি-সি-জি (B.C.G)। এগুলি ছাড়াও আরো কয়েকটি রোগের প্রতিষেধক টিকা ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে।
পাস্তুর নিজে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না, ছিলেন রসায়নের অধ্যাপক। কিন্তু ঘটনা চক্রে তিনি আবিষ্কার করেন যে, কোনো কোনো ব্যাধির মূল কারণ জীবাণু। পাস্তুর সর্বপ্রথম যে রোগটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন-সেটি হলো অ্যানথাক্স। এটি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হলে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দলে দলে গরু, ভেড়া প্রভৃতি মারা যায়। মানুষও বাদ যায় না এই রোগের আক্রমণ থেকে। যদি কোনো রাখাল কাটা বা ছড়ে যাওয়া হাত দিয়ে এদেরকে ছোঁয় তবে সেও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে শীঘ্রই মারা যায়। আবার যারা এই রোগে মৃত পশুর চামড়া নিয়ে কারবার করে তারাও রেহাই পায় না। এই রোগের কবল থেকে। কিন্তু এই রোগটি কেন হয়, জীবদেহে রোগটি কি করে সংক্রামিত হয়, মানুষের তা জানা ছিল না। পাস্তুরই সর্বপ্রথম নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করেন যে খুব ছোট ছোট কাঠির মতো, খালি চোখে দেখা যায় না, এমন ধরনের অনুজীব বা জীবাণু এই রোগটির জন্য দায়ী। এছাড়া সূতিকা জ্বর, চিকেন কলেরা এবং আরো দু’একটি রোগের জীবাণু তিনি আবিষ্কার করেন। এদিকে মনোযোগী হলে তিনি আরো কিছু রোগ জীবাণু আবিষ্কার করতে পারতেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু সে দিকে তিনি আর অগ্রসর হন নি। এ সময়ে পাস্তুরের দেখাদেখি অন্যান্য বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় আরো কিছু রোগ জীবাণু আবিষ্কৃত হলো । সংক্রামক ব্যাধির কারণ যে জীবাণু, সে কথাও স্বীকৃত হলো বিজ্ঞানী মহলে। তাই জীবাণু আবিষ্কারের ঝোঁক তাঁর কমে গেল। তিনি তখন এই সব সংক্রামক রোগ কি করে দমন করা যায় সে দিকেই মনোযোগ দিলেন। চিকেন কলেরার জীবাণু আবিষ্কারের পর ১৮৭৯ সালের দিকে তিনি মুরগীর স্যুপে এই জাতের জীবাণু বেশি করে গজিয়ে (culture) সেগুলি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন কি করে তাদেরকে রুগ্ন মুরগীর দেহের মধ্যেই মেরে ফেলা যায়। পরীক্ষার কাজ চলছে এমন সময় গরমের ছুটি এসে গেল। কাজ আপাতত বন্ধ রেখে তিনি ছুটিতে কিছু দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে গেলেন। ফিরে এসে তিনি আবার আগের কাজটিই শুরু করলেন। কিন্তু শুরু করতে গিয়েই বিপত্তি দেখা দিল। বেশ বিব্রত ও বিরক্ত বোধ করলেন তিনি। ছুটিতে যাওয়ার আগে যে সব জীবাণুর চাষ (culture) তিনি করেছিলেন কালচার প্লেটে, দেখা গেল, সে সব দিয়ে মোটেই কোন কাজ হচ্ছে না। বাচ্চা মুরগীকে এসব জীবাণু দিয়ে ইনজেকশন দিলে আগের মতো তাদের আর কলেরা হচ্ছে না। ইঞ্জেকশন দেয়ার পর তারা সামান্য একটু অসুস্থ হচ্ছে বটে—কিন্তু খুব শীঘ্রই তারা সেরে ওঠে। পাস্তুর ভাবলেন, চিকেন কলেরার জীবাণুগলি বেশি দিন সক্রিয় থাকে না। কিছু দিনের মধ্যেই তারা এতটাই দুবল বা নির্জীব হয়ে পড়ে যে রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদের আর থাকে না। কেননা, নতুন জীবাণুর চাষ করে তিনি দেখলেন—সেগুলি ঠিকই রোগসৃষ্টি করতে সক্ষম। বাচ্চা মুরগীকে এসব জীবাণু দিয়ে ইঞ্জেকশন দিলে তাদের সবকটিরই কলেরা হয়ে মারা যায়। এমনি পরীক্ষা যখন চলছে তখন একদিন দেখা গেল—একটি মুরগীর ছানা ঐ নতুন জীবাণুর ইঞ্জেকশন নিয়েও দিব্যি সুস্থ রইলো, কলেরা তার হলো না। ব্যাপার কি? এমনটা ব্যতিক্রম কেন? বেশ চিন্তায় পড়লেন পাস্তুর। অন্য সব মুরগীর বাচ্চাই যেখানে এই সব জীবাণু প্রয়োগের ফলে তাদের কলেরা হচ্ছে, মরছে, সেখানে এই বাচ্চাটির কলেরা হওয়াতো দুরের কথা রোগটির সামান্য একটু লক্ষণ দেখা দিল না কেন? অনেক চিন্তা ভাবনা ও খোঁজাখুজির পর একটিই মাত্র পার্থক্য পাওয়া গেল—সেটি হলো ঐ বাচ্চা টিকে আগে একবার ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছিল ঐ নিজীব বা নিস্তেজ জাতের জীবাণু দিয়ে এবং সেটি ভাগ্যক্রমে বেচে গিয়েছিল। তবে কী এই নিজীব জীবাণুগুলিই কোনভাবে দায়ী ঐ মুরগীর বাচ্চাটিকে নিশ্চিত কলেরার হাত থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার জন্য? নিস্তেজ জীবাণুগলিই কী কোনো রক্ষা কবচের মতো কাজ করছে ঐ বাচ্চাটির দেহে?
শুরু হলো পরীক্ষা। যে সব মুরগীর বাচ্চাকে আগে একবার পুরনো বা নির্জীব জীবাণু দিয়ে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছিল, সামান্য একটু রোগে ভূগে যারা এখন দিব্যি সুস্থ, এমন কয়েকটি বাচ্চা বেছে নিয়ে পাস্তুর তাদের প্রত্যেকটির দেহে ঢুকিয়ে দিলেন নতুন গজানো চিকেন কলেরার সক্রিয় জীবণু। দেখা গেল, এদের মধ্যে একটি বাচ্চারও কলেরা হলো না, এমন কি রোগের সামান্যতম লক্ষণও প্রকাশ পেল না তাদের মধ্যে। বোঝা গেল, যে সব মুরগীর বাচ্চাকে আগে একবার নিস্তেজ জীবাণু দিয়ে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছিল তাদের দেহে যেন এক আশ্চর্য, অলৌকিক শক্তি জন্মায়। তা না হলে কী করে তারা অনায়াসে প্রতিহত করতে পারে সক্রিয় জীবাণুর সংক্রমণ? কিন্তু প্রাণী দেহে কেন এই অপূর্ব শক্তি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায় তার কোন হদিস বা দিশা খুঁজে পেলেন না পাস্তুর।
জেনার (Edward Jenner)-ও জানতে পারেন নি কারণটা, যিনি পাস্তুরের আগে গুটি বসন্তের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। অবশ্য জেনার গো-বসন্তের জীবাণু দিয়ে গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে যে প্রতি রোধ শক্তি গড়ে তোলা যায় সেটাই আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানে ছিল একটি ভিন্ন জাতের রোগ জীবাণু দিয়ে অন্য একটি রোগ প্রতিরোধ করার ব্যাপার। কিন্তু পাস্তুরের ক্ষেত্রে সেটি ছিল ভিন্ন, একই রোগজীবাণুকে নিস্তেজ অবস্থায় জীবদেহে প্রয়োগ করে সেই রোগের বিরদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলা। আর এটি যে করা যায় পাস্তুর তা জেনেছিলেন এই আকস্মিক ঘটনার সূত্রে। অনুসন্ধান ও পরীক্ষা চালিয়ে পরিশেষে তিনি চিকেন কলেরার একটি সুষ্ঠু প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। তৈরি করার পদ্ধতিটিও ছিল খুবই সহজ। চিকেন কলেরার জীবাণু, গজিয়ে সেগুলিকে নিস্তেজ করার জন্য কিছুদিন রেখে দিলেই তৈরি হবে প্রতিষেধক টিকা, আর তাই দিয়ে বাচ্চা মুরগীকে ইঞ্জেকশন দেয়া। এই টিকা দেয়া বাচ্চাদের আর কলেরা হবে না। তাই একটি অতি সহজ উপায় উদ্ভাবন করে চিকেন কলেরার মড়ক প্রতিরোধ করলেন পাস্তুর।
অবশ্য তাঁর পরবর্তী কালের অ্যানথ্রাক্স ও বিশ্ববিখ্যাত জলাতঙ্ক (হাইড্রো ফোবিয়া) রোগের প্রতিষেধক টিকা তৈরি করা এতটা সহজ ছিল না—কিন্তু আবিষ্কারের সূত্রটি ছিল ঐ একই। রোগটির সক্রিয় জীবাণুকে নিস্তেজ করে টিকা তৈরি করা। আবার এই সত্র ধরেই আজও চলছে গবেষণা, আরো কিছু রোগের প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবন হয়েছে। এবং ইতিমধ্যে কয়েকটি মারাত্মক রোগের প্রতিষেধক টিকার আবিষ্কার ও বহুল প্রচলন যে ঘটেছে—সে কথা আগেই বলেছি। ভাবতে পার, এই কয়েক দশক আগেও যেখানে ডিপথেরিয়ায় হাজার হাজার শিশু মারা যেতো, শতকরা পাঁচজনও বাঁচতো না আর টিটেনাস ও জলাতঙ্ক রোগীর মৃত্যু ছিল নিশ্চিত, সেখানে এসব রোগকে যেমন প্রতিষেধক টিকার সাহায্যে অনায়াসে প্রতিরোধ করা যায়, তেমনি তোমরা যারা বাচ্চা বয়সে ডি-পি-টি, বি-সি-জি নামের প্রতিষেধক টিকা নিয়েছে তাদের একটুও ভাবনা আর ভাবতে হবে না যে ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি,টিটেনাস, যক্ষা রোগে কখনও ভুগবে, অকালে মরবে। তবে যে কথাটা বলার জন্য এত কিছু, বলা সেটা হলো পাস্তুরের ঐ স্বরণীয় বাণীটি তোমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়।। Chance only favours the prepared mind'-কথাটা যে কতটা সত্যি তার সত্যিকার প্রমাণ পাওয়া যায় পাস্তুরের ঐ চিকেন কলেরার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের ঘটনাটি থেকেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন