লুই পাস্তুর,জলাতঙ্ক রোগ,Louis Pasteur,Rabies,Hydrophobia |
লুই পাস্তুর ও জলাতঙ্ক রোগ – Louis Pasteur and Rabies ( Hydrophobia )
এনথ্রাক্সের পর পাস্তুরের নজর পড়ল র্যাবিস (Rabies) বা জলাতঙ্ক (Hydrophobia) রোগের দিকে। পাগলা কুকুর কামড়ালে জলাতঙ্ক রোগ হয়। রোগীর প্রচণ্ড পিপাসা পায়, কিন্তু কিছুতেই পানি খেতে চায় না সে। অতি ভয়ংকর রোগ এটা—ডাক্তারি শাস্ত্রের ইতিহাসে তখন পর্যন্ত জলাতঙ্ক রোগ হয়ে একটি লোকও বাঁচেনি। পাস্তুর ভাবলেন, অন্যান্য রোগ যদি জীবাণু থেকে হয় তা হলে জলাতঙ্কেরও নিশ্চয়ই জীবাণু আছে। আর এই জীবাণুকে কাবু করতে পারলে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক বের করা যাবে।
জীবাণুকে কাবু করতে হলে আগে তো তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু পাগলা কুকুরের রক্তে কিছুতেই জীবাণু খুঁজে পাওয়া গেল না। পাগলা কুকুরের মুখ খেকে গেঁজা উঠতে থাকে, অনবরত লালা ঝরে। কাচের নল নিয়ে কুকুরের ফেনানো মুখ থেকে লালা নিয়ে তিনি পরীক্ষা করতে লাগলেন। শেষটায় তিনি বুঝলেন, জলাতঙ্কের জীবাণু দেখা যাক বা না যাক সেগুলো গিয়ে জমা হয় শিরাড়ায় আর মগজে। পাগলা কুকুরের মগজ বের করে অন্য কুকুরের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি দেখলেন অল্প কদিনের মধ্যেই সেটাও পাগল হয়ে যায়। এবার শুরু হল অনেক কুকুর আর খরগোশ নিয়ে তাঁর পরীক্ষা।
পাগলা কুকুরের জীবাণু খরগোশের গায়ে ঢুকিয়ে দিয়ে তার মগজ আর শিরদাড়া যেখানে মিশেছে তিনি বের করলেন সেখানকার খানিকটা মজ্জা। এই মজ্জা তিনি হাওয়ায় ঝুলিয়ে শুকালেন চোদ্দ দিন ধরে। দেখা গেল এমনি বাস-হওয়া মজ্জা পাগলা কুকুর কামড়ানো জন্তুর শরীরে ঢোকালে তার আর জলাতঙ্ক হয় না।
কিন্তু কুকুরের জলাতঙ্ক ঠেকাতে পারা এক কথা, আর মানুষের জলাতঙ্ক ঠেকানো আরেক কথা। মানুষের গায়েও কি এই বিষাক্ত জীবাণু ঢুকিয়ে দিলে তার জলাতঙ্ক ঠেকানো যাবে? অনেক ভেবে ভেবে তিনি ঠিক করলেন নিজেই পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে তারপর এই বাসি জীবাণু ঢোকাবেন শরীরে।
ভাগ্যক্রমে পরীক্ষার এক আশ্চর্য সুযোগ জুটে গেল হঠাৎ। ১৮৮৫ সালের ৬ই জুলাই তারিখে তার গবেষণাগারে এল একটি ন'বছরের ছেলে নাম তার জোসেফ মেইস্টার ( Joseph Meister )। মেইস্টারের সারা গায়ে পাগলা কুকুরের বীভত্স কামড়ের দাগ-রক্ত আর কুকুরের লালায় সারা শরীর মাখানো। ডাক্তাররা দেখে বললেন জলাতঙ্ক হয়ে এর মৃত্যু নিশ্চিত। পাস্তুরের টিকায় যদি
এখন কিছু হয়। পাস্তুর তার গায়ে ইনজেকশন করে
দিলেন চোদ্দ দিনের পুরনো টিকা। পরদিন দেয়া হল তেরো দিনের পুরনো টিকা। এমনি করে দু'সপ্তাহ ধরে চলল চিকিৎসা। আর আশ্চর্য! ছেলেটি
ভাল হয়ে গেল নিশ্চিত জলাতঙ্কের হাত থেকে বেঁচে গেল সে। লুই পাস্তুর,জলাতঙ্ক রোগ,Louis Pasteur,Rabies,Hydrophobia,জোসেফ মেইস্টার,Joseph Meister
আবার চারদিকে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল। বিদ্যুদ্বেগে
সারা দুনিয়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ল, পাস্তুর জলাতঙ্কের
প্রতিষেধক আবিস্কার করে ফেলেছেন। নানা জায়গা থেকে তাঁর কাছে রোজ এসে হাজির হতে লাগল
পাগলা কুকুর কামড়ানো অসংখ্য লোক। ছ'মাসে যে সাড়ে তিনশো লোক
এল তার মধ্যে সবাই ভাল হল – শুধু একটি মেয়ে ছাড়া। তাকে আনা হয়েছিল
পাগলা কুকুরে কামড়াবার সাইত্রিশ দিন পর; তখন আর চিকিৎসার কোনো
উপায় ছিল না। পাস্তুরের চিকিৎসায় এক বছরে প্রায় এক হাজার লোকের জীবন রক্ষা পেল।
লুই পাস্তুর,জলাতঙ্ক রোগ,Louis Pasteur,Rabies,Hydrophobia
এবার পাস্তুরের গবেষণাগারের জন্যে নিজস্ব বাড়ি চাই। দু'হাতে চাঁদা দিতে লাগল সবাই। দেশে দেশে স্কুলের ছেলেমেয়েরা লেগে গেল চাদা তুলতে। মিলানের এক খবরের কাগজ চাঁদা তুলল চারশো পাউন্ড (সেই সময় চারশত পাউন্ড বিশাল অঙ্কের টাকা)।
লুই পাস্তুর,জলাতঙ্ক রোগ,Louis Pasteur,Rabies,Hydrophobia
রাশিয়ার জার পাঠালেন সাত হাজার পাউন্ড। সাহায্য পাঠালেন ব্রাজিলের সম্রাট, তুরস্কের সম্রাট। অবশেষে ১৮৮৮ সালে প্যারিতে পাস্তুর ইন্সটিটিউটের উদ্বোধন করলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিজে।
পাস্তুর ডাক্তার ছিলেন না। কিন্তু রোগজীবাণুকে কাবু করবার, রোগ ঠেকাবার যেসব উপায় তিনি আবিষ্কার করেছেন তার সমান আবিষ্কার ডাক্তারি শাস্ত্রে আর কখনো হয়নি। এর পর দেখতে দেখতে তার সহকর্মীরা আবিষ্কার করলেন আরও নানা রোগের প্রতিষেধক বিউবোনিক প্লেগ, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা, পোলিও (শিশু পক্ষাঘাত), টাইফাস ইত্যাদি।
পাস্তুর তার দেশের জন্য এনেছেন অসামান্য সম্মান। রেশম শিল্পকে বাঁচিয়ে, পশু-পাখির মড়ক দূর করে, নানা রোগের টিকা আবিষ্কার করে দেশের অসাধারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। বিজ্ঞানের দানকে সত্যিকারভাবে নিয়োগ করেছেন সাধারণ মানুষের সেবায়।।
শুধু তা-ই নয়। পাস্তুর বলেছেনঃ বিজ্ঞান তো কোনো দেশের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, তার প্রত্যেকটি বিষয়ে রয়েছে সমগ্র মানবসমাজের অধিকার। -সত্যি কি আজও বিজ্ঞানের বিজয়ে সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? তযেদিন হবে সেদিনই সার্থক হবে পাস্তুরের সারাজীবনের অক্লান্ত সাধনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন