শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১

বিজ্ঞানী মেরী কুরী ও রেডিয়াম আবিষ্কারের গল্প – Marie Curie and story of the discovery of Radium

 

বিজ্ঞানী মেরী কুরী,রেডিয়াম আবিষ্কারের গল্প,life of Marie Curie,story of the Discovery of Radium,

বিজ্ঞানী মেরী কুরী ও রেডিয়াম আবিষ্কারের গল্প Marie Curie and story of the discovery of Radium

জন্মঃ ৭ই নভেম্বর ১৮৬৭ মৃত্যুঃ ৪ঠা জুলাই ১৯৩৪

বিজ্ঞান ও আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে--- মেরী কুরী বাস্তবতার আঘাতে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েও করেননি এবং সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বরে মারিয়া স্কলোদোভস্কা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতা ছিলেন পোল্যান্ডের কৃষিজীবী পরিবার। কিন্তু শিক্ষার প্রতি

অনুরাগে তাঁরা কৃষি পেশা ত্যাগ করেন।

তাঁর পিতা ছিলেন দক্ষ একজন পিয়ানোবাদক। বাল্যকালেই মারিয়ার জীবনে দুঃখ নেমে আসে। মেরীর ১০ বছর বয়সে যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা পরলোক গমন করেন 

সেই সময়ে পোল্যান্ড ছিলো জার শাসিত রাশিয়ার কলোনী। পোলিশদের বিদ্রোহের প্রচেষ্টার প্রতিশোধরূপে পেট্রোগ্রান্ড সরকার তাদের উপর কঠিন বিধি-নিষেধ জারি করেন। মারিয়ার পিতা তাঁর স্কুলের চাকুরি হারান। কারণ, পোল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিতে তিনি ছিলেন প্রতিবাদমুখর। এই পরিস্থিতিতে অবশিষ্ট চারটি সন্তানের (তাদের একটি সন্তান টাইফয়েডে মারা যায়) ভরনপোষণের জন্য তিনি একটি বোডিং স্কুল খোলেন। এই প্রচেষ্টাও বেশী সফল হয়নি, অবশ্য কোনোক্রমে পরিবারের ভরণপোষণ চলে যায়।

১৮৮৩ সালে হাই স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় মারিয়া স্বর্ণ পদক লাভ করেন। পদক লাভ স্কলোদোভী পরিবারের পুরনো ঐতিহ্য। পরিবারে পদক প্রাপ্তদের মধ্যে মারিয়া হলেন তৃতীয়। আর্থিক অবস্থা ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে অধ্যাপক স্কলোদোভস্কা তাঁর সন্তানদের কৃতিত্বের মধ্যে আনন্দ ও সুখ খুঁজে পান। হাই স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর মারিয়াকে এক বছরের জন্যে দেশের বাড়িতে পাঠানো হয়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা তাঁর পিতাকে ব্যাকুল করে রেখেছিলো। গ্রামের বাড়িতে দীর্ঘ অবকাশ যাপন তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মের জন্যে ভালো হতে পারেএটা তার পিতার ধারণা।

পোল্যান্ডের পল্লীনৃত্যে যথেষ্ট শক্তি সামর্থের প্রয়োজন হতো। এই নাচ সূর্যাস্তে শুরু হতো, সারারাত চলতো, পরবর্তী দিনও নাচ অব্যাহত থাকতে এবং তার পরের রাত্রিতে শেষ হতো। মারিয়াও নাচকে খুবই ভালোবাসতেন।

তাঁর অবকাশের দিন এক সময় শেষ হয়ে গেলো। তিনি ওয়ারশতে ফিরে এলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে বাড়িতে আলোচনা হলো। কিন্তু অর্থছাড়া তিনি কি করে প্যারিসের সোরবোর্নে যেতে পারেন? বড়ো বোন ব্রোনিসলাওার সঙ্গে অনেক আলাপ আলোচনার পর দুই বোন মিলে একটা পথ বের করলেন। মারিয়া চাকুরী নেবে এবং ব্রোনিসলাওাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাহায্য করবে। তার পর ব্রোনিসলাওা চাকুরী নিয়ে মারিয়ার পড়াশোনার খরচ যোগাবে। যথা চিন্তাএকদিন হলোও তাই।

একজন অভিজাত রাশিয়ানের গৃহে গভর্নেন্স ও শিক্ষিকার চাকুরি লাভ করেন মারিয়া। কিন্তু তাঁর গৃহকর্তী ছিলেন অসহিষ্ণু এবং বদরাগী, তাই তাঁর কপালে চাকুরি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। সৌভাগ্যবশতঃ মারিয়া পূর্বের চাইতে ভালো পরিবেশে অন্য একটি চাকুরী লাভ করেন। এই পরিবারের বড়ো ছেলেটি ছিলেন ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছুটিতে ছেলেটি বাড়ি আসেন এবং সহজেই সুন্দরী গভর্নেসের প্রেমে পড়েন। ছেলেটি নাচতে পারতো এবং তাঁর কথাবার্তাও ছিলো পন্ডিতদের মতো। নিঃসঙ্গ মারিয়া তার আবেদনে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন। কিন্তু ছেলের মা এই বিয়েতে বাঁধ সাধলেন তিনি কিছুতেই তার ছেলেকে একজন গভর্নেস্ বিয়ে করতে দেবেন না। তখন মারিয়া ঐ গৃহ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং একটি চিরকুটে ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন, ঘৃণিত এই পৃথিবী থেকে আমি বিদায় নিতে চাই। ক্ষতি হবে খুবই সামান্য.."

এরপর মারিয়া অন্যত্র শিক্ষকতার চাকুরি নেন এবং সোরবোর্নে বড়ো বোনের নিকট টাকা পাঠাতে থাকেন। অবশেষে একদিন মারিয়ার পালা এলো। বড়ো বোন প্যারিস থেকে শুধু মেডিক্যাল ডিগ্রিই নিয়ে এলেন না, সাথে একজন সহপাঠী মেডিক্যাল ছাত্রকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন।

২৩ বছর বয়সে তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবের ছোঁয়া পেলো। মেরী সোরবোনের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। চার চারটি বছর ধরে তিনি কাজ এরং পড়াশোনা চালিয়ে যান হঠাৎ করেই তিনি রোগের শিকার হলেন তিনি একটা চিলেকোঠায় থাকতেন এবং সেখানে তাপ ব্যবস্থা ছিলো না। খাদ্যের জন্য তাঁর অর্থ অত্যন্ত সামান্যই ছিলো। তাঁর খাবার মূলতঃ রুটি, মাখন এবং চা। একবার তো পুরো দিন তিনি মূলো খেয়ে কাটিয়ে ছিলেন। তার খাদ্যের তালিকায় মাংস এবং ডিম খুব কমই স্থান পেতে।

কিন্তু তিনি বেঁচে রইলেন এবং বেঁচে থেকে গণিত, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সঙ্গীত ও কাব্য অধ্যয়ন করলেন। অধ্যয়নের ফাঁকে ফাঁকে তিনি রাসায়নিক গবেষণাগারের বোতল পরিষ্কারের কাজ করতেন পদার্থ বিজ্ঞানে ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি স্টার মার্কসহ প্রথম স্থান লাভ করেন এবং পরবর্তী বছরেই গণিতে সর্বোচ্চ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এই সময়ে মেরীর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। প্রেমের প্রথম নীল অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে লুকায়িত থাকে। সুন্দরী, স্বর্ণকেশী, নমনীয় আকৃতির মেরী নিজের মধ্যেই মগ্ন ছিলেন।

২২ বছর বয়সে পিয়েরে কুরী লিখেছিলেন, প্রতিভাময়ী নারী খুবই বিরল এবং নারীরা সাধারণতঃ বিজ্ঞান সাধনায় সক্রিয় প্রতিবন্ধক।

পিয়েরের বয়স যখন ৩৫ তখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে আরো জোরদার হলো। তিনি বিদ্যুৎ এবং চুম্বকতত্ত্ব সম্পর্কে এক জটিল গবেষণা করছিলেন। অধ্যাপক পল শুৎজেনবার্জারের গবেষণাগারে তিনি তাঁর ভ্রাতা জ্যাকুইসকে নিয়ে কাজ করছিলেন। পিয়েরে কুরী মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ইতিমধ্যেই তিনি পিজো-বিদ্যুৎ সূত্র উদ্ভাবন করে বিজ্ঞান ভূবনে সম্মানিত আসনে উন্নীত হয়েছিলেন। রেকর্ড প্লেয়ারের স্বচ্ছ আওয়াজের সঙ্গে এই পিজো-বিদ্যুতের সূত্র জড়িত। রেকর্ড প্লেয়ারের স্বচ্ছ কাচের চাকতি ঘোরালে অল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। পিয়েরে ও মেরী সর্বপ্রথম অধ্যাপক কোভ্যালীর গৃহে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হন। কোভ্যালী ছিলেন একজন পোলিশ বিজ্ঞানী এবং তিনি সে সময়ে প্যারিস সফর করছিলেন। প্রথম সাক্ষাতে তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান নিয়েই কথাবার্তা হয়েছিলো।

মেরী তাঁর সঙ্গে পুনরায় দেখা করার জন্যে পিয়েরেকে অনুরোধ করেন। শুধু বিজ্ঞান নিয়েই কি কথা হয়েছিল? নাহ, আলোচনার ফলে মেরী পিয়েরের সঙ্গে অধ্যাপক শুৎজেনবার্জারের গবেষণাগারে কাজ করার অনুমতি লাভ করেন। পরবর্তী এক বছরের মধ্যেই মারিয়া স্কলোদোভস্কা মেরী কুরী নামে পরিচিত হন।

পিয়েরে লিখেছিলেন, প্রতিভাময়ী নারী বিরল। ...

সেই বিরল নারীরই সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। তার পত্নী ছিলেন একজন প্রতিভাময়ী নারী। মেরী সানন্দে তাঁর স্বামীর সঙ্গে গবেষণাগারে চুম্বক ও বিদ্যুতের সমস্যাবলী নিয়ে কাজ করতে থাকেন।

জার্মানীতে বিজ্ঞানী উইলহেল রন্টজেন একটি নতুন রশ্মি আবিষ্কার করেছিলেন। এই রশ্মি অধিক তীক্ষ্মশক্তি সম্পন্ন। ১৮৯৬ সালের জানুয়ারীতে বিশ্ব বিজ্ঞানী সংস্থার নিকট তিনি এই রশ্মির কথা ব্যাখ্যা করেন। তিনি এর নাম দেন এক্স রশ্মি এবং প্রমাণ করেন যে, এই রশ্মি কঠিনতম পদার্থ ভেদ করতেও সমর্থ এদিকে ফ্রান্সে অধ্যাপক হেনরী বেক্বেরেল অণুপ্রভার সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছিলেনএটা হলো কতোগুলো পদার্থ অন্ধকারেও জ্বল জ্বল করে। কিন্তু কেনো? পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে তার মনে এই বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, অপরিশোধিত খনিজ পদার্থ ইউরেনিয়াম পিচ-ব্রেন্ডের মধ্যে ইউরেনিয়াম ছাড়া অন্য আরো কিছু ভিন্ন পদার্থ আছে।

গবেষণার ক্ষেত্রে মেরী কুরীর দক্ষতায় অধ্যাপক বেকেরেল অনেক আগেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এই সমস্যাটা কুরীর নিকটেই তুলে ধরলেন। যে উপাদানটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন, তা কোনো পরিচিত উপাদান হতে পারে না! এটা নিশ্চয়ই নতুন কোন উপাদান হবে। স্বামী-স্ত্রী তখন অন্যসব কাজের চিন্তা বাদ দিয়ে এই রহস্য উদ্ঘাটনেই উঠে পড়ে লাগলেন।  

পিচ-ব্রেন্ড অত্যন্ত মূলাবান খনিজ পদার্থ এবং এটা অস্ট্রিয়া ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এখন তাদের ভাবনা বিনা পয়সায় কি করে কিছুটা পিচ-ব্রেন্ড পাওয়া যেতে পারে? তারা ভাবলেন যে, পিচব্রেন্ডে এই অজ্ঞাত উপাদান থেকে থাকলে ইউরেনিয়াম বের করে নেওয়ার পরও উচ্ছিষ্ট অংশে এই উপাদান থেকে যাবে। তারা তখন অস্ট্রিয়া সরকারের সাথে যোগাযোগ করলেন। অস্ট্রিয়া সরকার পিচ-ব্রেন্ডের উচ্ছিষ্ট অংশ শুধুমাত্র পরিবহন খরচের বিনিময়ে তাঁদের পাঠাতে রাজী হলেন।

একদিন পিচ-ব্রেন্ডের কয়েক টন উচ্ছিষ্ট পুরো জাহাজ ভরে তাঁদের গবেষণার জন্যে প্রেরণ করা হলো। এর পর শুরু হলো বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি অতি রোমাঞ্চকর গবেষণা পর্ব। কুরী দম্পতি অপরিশোধিত খনিজ পদার্থকে পরিশোধন করতে লেগে গেলেন একটা বিরাট পাত্রে তাঁরা এগুলোকে জ্বাল দিতে লাগলেন ধোয়ার উৎপাত সহ্য করা সম্ভব না হওয়ায় একদিন তাঁরা তাঁদের কর্মকান্ড বাসগৃহের পেছনের আঙিনায় স্থানান্তরিত করেন তারপরেও সর্বক্ষণ গবেষণা অব্যাহত রাখেন।  

১৮৯৬ সালের পুরোটা শীতকাল মেরী দম্পতি তাঁদের ময়লা স্টোভ নিয়ে পরিশ্রম করেই চলছিলেন। প্রচুর খাঁটুনির ফলে মেরী নিমোনিয়ায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। পিয়েরে চুল্লী গুতিয়েই চললেন। এদিকে তিন মাস রোগ ভোগের পর মেরী কেতলী কড়াইয়ের রাজ্যে (গবেষণায়) আবার ফিরে এলেন।

১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে মেরীকে দ্বিতীয়বার রোগে শয্যাশায়ী হতে হয়। তখনও তিনি ময়লা সব আবর্জনা পরিশোধন এবং পরিশুদ্ধ করে চলেছিলেন। তবে এবারে তার শয্যা গ্রহণ অবশ্য মাতৃত্ব লাভের কারণে। মেরী একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিলেন তাঁর কন্যার নাম রাখা হলো, আইরিন। এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যেই মেরী পুনরায় গবেষণাগারে ফিরে গেলেন। শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায় তিনি কি একটা নতুন চিন্তা করেছিলেন, এবার তিনি সেটার পরীক্ষা করতে লেগে গেলেন। একবার মনে হলো যে, বেবী আইরিনের দেখাশোনার জন্যে তাঁকে গবেষণাগারের কাজ গুছিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সদ্য বিপত্নীক ভাই কুরী পিয়েরেও মেরীর সঙ্গেই বসবাসের জন্যে চলে এলেন এবং বোনের সব কথা শুনে তিনি আনন্দে শিশু আইরিনকে দেখাশোনা করতে রাজী হলেন। এতে তিনি নিজেও বেশ শান্তি খুঁজে পেলেন।  

মেরী পিচ-ব্লেন্ড পরিশোধনের কাজে ফিরে গেলেন। দু'বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর তাঁরা তাঁদের পরিশ্রমের ফল স্বরূপ পেলেন সামান্য পরিমাণ বিসমাথ এর যৌগ কিন্তু এই বিসমাথ, ইউরোনিয়াম থেকে ৩০০ গুণ অধিক কার্যকর। ছবি তোলার ফিল্মে বিসমাথ আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করে বিসমাথের মধ্যে নিশ্চয়ই তাঁদের প্রাপ্ত উপাদানের বাইরেও কিছু রয়েছে একথা ভেবে আরো নতুন কিছুর সন্ধানের জন্যে মেরী আবারও গবেষণাগারে ফিরে গেলেন।

১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে তিনি এক নতুন উপাদান আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির নাম অনুসারে তিনি এই নতুন উপাদানের নাম রাখলেন, পোলোনিয়াম কিন্তু কুরী দম্পতি এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। কারণ, তাঁদের মনে হলো, পোলানিয়াম আহরণের পরেও অবশিষ্ট পদার্থ পোলোনিয়াম থেকে অধিক উজ্জ্বল থেকে যায়

হয়তো আরো ও ভিন্ন নতুন কোন উপাদান রয়ে গেছে, তাই পরিশোধন এবং স্বচ্ছতা রক্ষার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলেন। অবশেষে কিছুদিন পর আরো একটা নতুন উপাদন পাওয়া গেলো। এই নতুন উপাদান হলো সামান্য পরিমাণ স্ফটিক। তাঁরা এই নতুন পদার্থটির নাম দিলেন, রেডিয়াম।

রেডিয়াম এক অদ্ভুত উপাদান। রেডিয়াম ইউরেনিয়াম থেকে ১০ লক্ষ গুণ অধিক তেজস্ক্রিয়তা শক্তি সম্পন্ন। ছবি তোলার ফিল্মের আলোক সচেতন উপাদানকে রেডিয়াম স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রভাবিত করে। এমন কি, ফিল্ম আলো প্রতিরোধক কাগজে আবৃত থাকলেও এই অঘটন ঘটে যায়। রেডিয়াম বায়ুতে গ্যাসের মলিকিউলকে বিদ্যুতায়িত করে অর্থাৎ এটা গ্যাসকে বিদ্যুৎ বহনের উপযোগী করে। অন্যান্য যৌগিক পদার্থের সাথে মিশ্রণের ফলে রেডিয়াম যৌগিক প্রতিপ্রভতা (fluorescence) উৎপন্ন করে। কোনো কোনো হাত ঘড়ির চিহ্ন ঔজ্জ্বল্যের কারণ একটাই, তাতে সামান্য পরিমাণ রেডিয়াম রয়েছে। রেডিয়াম বিকিরণ বীজের উদগমন বন্ধ করতে, রোগ জীবাণু ধবংস করতে, এমন কি ক্ষুদ্র প্রাণীকেও হত্যা করতে পারে এক মুহুর্তে।

এই বিকিরণ মাংসপেশী নষ্ট করতেও সক্ষম। তাই ক্যান্সার এবং নির্দিষ্ট অনেকগুলো চর্মরোগের চিকিৎসায় আজকাল রেডিয়াম ব্যবহৃত হয়। এটা ক্রমাগত তাপ নিঃসরণ করে। রেডিয়াম নিজের থেকেই এই তাপ বিকিরণ করে। অর্থাৎ রেডিয়াম সহজ পরমাণুতে নিজেকে বিলিয়ে দেয় এবং এই ভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটায় নিঃসন্দেহে রেডিয়াম যুগ-যুগান্তরের এক অনন্য উপাদান এ কথাটি বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বময়।

এবার সমস্ত পৃথিবী কুরী-দম্পতির পেছনে লেগে গেলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁদের নিকট বিভিন্ন প্রস্তাব আসতে লাগলো। কিন্তু তাঁরা তাঁদের আবিষ্কারকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে অস্বীকার করলেন। এই কীর্তির জন্যেই

বেকেরেলের সঙ্গে মিলিত ভাবে নোবল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তাঁরা তাঁদের পুরনো ঋণ শোধ করেন। পিচ-ব্রেন্ড নিয়ে পরিশোধন ও পরীক্ষা নিরীক্ষার কবছরে তাঁদের ধার-দেনা করতে হয়েছিলো প্রচুর।

নোবেল প্রাপ্তির পরে পিয়েরে কুরী সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ লাভ করেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অত্যন্ত সুসজ্জিত গবেষণাগার ব্যবহারের সুযোগও লাভ করেন একই সাথে

১৯০৪ সালে দ্বিতীয় কন্যা ইভ জম্মগ্রহণ করেন। এই সময়ে তাঁরা পূর্বের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক বেশী সুখী দম্পতিরূপে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ এক নির্মম দুর্ঘটনা এই সুখী যুগল জীবনের অবসান ঘটায়।।

১৯০৬ সালের ১৯শে এপ্রিল পিয়েরে কুরী বিজ্ঞান সভা থেকে ঘরে ফেরার সময় হঠাৎ রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েন। একটা ঘোড়ার গাড়ি আচমকা এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং পরক্ষণেই বিপরীত দিক থেকে আগত একটা ভারী গাড়ি তার উপর দিয়ে চলে যায়। রাজপথে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ভগ্ন হৃদয় মেরী পাথর হয়ে গেলেন। গবেষণাগারে কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই তিনি সান্ত্বনা খুঁজতে চেষ্টা করলেন। রাতে তিনি স্বামীর উদ্দেশ্য পত্র লিখে সময় কাটাতেন। এইসব পত্রে তিনি দিনের গবেষণাগারের সমস্ত কাজের বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে থাকলেন। ফ্রান্স সরকার সকল পুরনো ঐতিহ্য মুছে দিয়ে মেরীকে পিয়েরের শূন্য পদার্থ বিজ্ঞানের সম্মানী আসন গ্রহণের প্রস্তাব দিলেন

এতে কোনো কোনো বিজ্ঞানী হিংসায় প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। একজন নারী পাবেন এই সম্মানীয় আসন? অসম্ভব, অচিন্তনীয়! তাঁরা আরো বললেন,-পিয়েরেই তো ছিলেন আসল ব্যক্তি, মেরীতে মাত্র স্বামী-কে কিছু মাত্র সহায়তা করেছেন শুধু।

এক সময় মেরী কুরী প্রমাণ করলেন-না, এককভাবে তিনিও তাঁর স্বামীর মতোই কৃতি বিজ্ঞানী। ১৯১০ সালে মেরী কুরী একক প্রচেষ্টায় বিশুদ্ধ অবস্থায় রেডিয়ামকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন। গলিত রেডিয়ামের ক্লোরাইডের ভিতর দিয়ে তিনি বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত করেন এবং পারদপূর্ণ ঋনাত্মক ইলেকট্রোডে পারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন এবং তিনি চুলোয় জ্বাল দিয়ে পারদ মুক্ত করে ফেলেন। দেখা গেলো মুক্ত উপাদান রেডিয়াম নিচে পড়ে রয়েছে এই একক কৃতিত্বের জন্যে দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন বিজ্ঞানী মেরী কুরী

১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই এই কৃতী মহিলা বিজ্ঞানী পরোলোক গমন করেন। বহু বছর ধরে বিকিরণের মধ্যে কাজ করায় তাঁর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো এক এক করে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কর্মের প্রতি তিনি এতোটা নিবেদিত ছিলেন যার ফলে তিনি বুঝতে পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে।

তাঁর আবিষ্কৃত রেডিয়ামই তাঁকে জয় করে নিয়ে যায় নিয়তির বিধান তাঁর চিরদিনের বাসভূমে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন