সায়েন্স ফিকশন - প্রোফেসর
শঙ্কু ও রোবু - সত্যজিৎ রায় - Professor Shonku and Robu - Satyajit Ray ২য় পর্ব (২ পর্ব)
১ম পর্ব পড়ুন
১ম পর্বের পর থেকেঃ
বোর্গেল্টের
নিজের হাবভাবও এই দাবড়ানির চোটে একটু আড়ষ্ট বলে মনে হলো। তিনি একের পর এক
কঠিন অঙ্কের প্রশ্ন রোবুকে করতে লাগলেন, আর রোবুও যথারীতি
পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ডের মধ্যে প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব
দিয়ে গেল। গর্বে আমার বুকটা ফুলে উঠল। বোর্গেল্টের
দিকে চেয়ে দেখি এই চল্লিশ ডিশ্রী শীতের মধ্যেও তার কপালে বিন্দু
বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে।
প্রায় পাচ
মিনিট প্রশ্ন করার পর রোর্গেল্ট আমার দিকে ফিরে বললেন,
“অঙ্ক ছাড়া আর কী জানে
ও?”
আমি বললাম,
“আপনার বিষয়ে ওর অনেক
তথ্য জানা আছে- জিগ্যেস করে দেখতে পারেন।”
আসবার আগে
একটা জার্মান বিজ্ঞানকোষ থেকে বোর্গেল্ট এর জীবন সংক্রান্ত অনেক
খবর রোবুর মধ্যে পুরে দিয়েছিলাম। আমি আন্দাজ করেছিলাম যে,
বোর্গেল্ট রোবুকে প্রশ্ন করতে পারেন।
বোর্গেল্ট আমার কথা শুনে বেশ একটু অবাক হলেন। তারপর বললেন, “এত জ্ঞান তোমার যন্ত্রের? বেশ, বল তো
হের্ রোবু আমার নামটি কী?”
রোবুর মুখ
দিয়ে কথা বেরোলো না। এক সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড এক মিনিট - কোনো উত্তর নেই, কোনো
শব্দ নেই, কোনো কিছু নেই। রোবু যেন ঘরের আর সব টেবিল চেয়ার আলমারি যন্ত্রপাতির মতই নিষ্প্রাণ,
নিজীব।
এবারে আমার
ঘাম ছোটার পালা। আমি এগিয়ে রোবুর মাথার উপরের বোতামটা নিয়ে টেপাটেপি করলাম,
এটা নাড়লাম, ওটা নাড়লাম-এমনকি রোবুর সমস্ত শরীরটাকে নিয়ে বারবার ঝাঁকুনি দিলাম-ভিতরের
কলকব্জা সব ঝনঝন করে উঠল- কিন্তু কোনো ফল হলো না।
রোবু আজ
আমার এবং ভারতীয় বিজ্ঞানের সমস্ত মানসম্মান এই দুই বিখ্যাত বিদেশী বৈজ্ঞানিকের সামনে
মাটিতে মিশিয়ে দিল।
বোর্গেল্ট মুখ দিয়ে হুঃ করে একটা শব্দ করে বলল, “ওটার যে একটা বড় রকম
ডিফেন্ট রয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাই হোক-
অঙ্কটা ও ভালই জানে। যদি অসুবিধা না হয়, কাল বিকেলে ওটাকে
নিয়ে একবার আমার বাড়িতে গেলে আমি সারিয়ে দিতে পারব বলে মনে হয়। আর আমারও কিছু দেখাবার
আছে। তোমাদের দুজনেরই নেমন্তন্ন রইল।”
বোর্গেল্ট
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
পমার আমার
মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন, আর আমিও বুঝতে পারছিলাম তিনি নিজেও খুব বিব্রত
বোধ করছেন। বললেন, “আমার কাছে ব্যাপারটা
ভারি আশ্চর্য লাগছে। এসো তো দেখা যাক ও এখন আবার ঠিকমত কথা
বলছে কিনা।”
ল্যাবরেটরিতে
ফিরে গিয়ে রোবুকে প্রশ্ন করতে সে আবার যথারীতি জবাব দিতে শুরু করল। হাটাচলাও
ঠিকই করল। বুঝতে পারলাম যে ঠিক ওই একটা প্রশ্নের মুহূর্তে ওর মধ্যে কোনো একটা সাময়িক
গণ্ডগোল হয়েছিল যার জন্য বেচারা জবাবটা দিতে পারেনি। এ ব্যাপারে দায়ী করতে হলে আমাকেই
করতে হয়। ওর আর কি দোষ?
সন্ধ্যার
দিকে বোর্গেল্টের কাছ থেকে টেলিফোন এলো। ভদ্রলোক আগামীকালের নেমন্তন্নের কথা মনে করিয়ে
দিলেন। রোবুকে নিয়ে আসার কথাটাও আবার বললেন, “আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে
না, কাজেই তোমার যন্ত্র যদি গণ্ডগোলও করে, বাইরের
কারুর কাছে অপদস্ত হবার কোনো ভয় নেই তোমার।
মন থেকে
অস্বস্তি যাচ্ছিল না। কাজেই পাছে রাত্রে
ঘুম না হয় সেই জন্য আমার তৈরি ঘুমের ওষুধ সমনোলিনের একটা বড়ি
খেয়ে নিয়েছি।
একটা কথা
মনে পড়ে খটকা লাগল। কাল মাঝ রাত্রিতে খুট খুট আওয়াজ কেন হচ্ছিল? পমার নিজেই কি
ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলেন নাকি? রোবুর ভিতরের কলকজা তিনি কিছু বিগড়ে দেননি তো? পমার
আর বোর্গেল্টের মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে না তো?
২৭শে মে
কাল দেশে
ফিরব। হাইডেলবার্গের বিভীষিকা কোনদিন মন থেকে মুছবে বলে মনে হয় না। তবে
একটা নতুন জ্ঞানলাভ করেছি এখানে এসে। এটা বুঝেছি যে, বৈজ্ঞানিকেরা সম্মানের যোগ্য হলেও,
তারা সকলেই বিশ্বাসের যোগ্য নন। কিন্তু যখন ঘটনাটা ঘটল তখন এসব কথা কিছুই মনে হয়নি।
তখন কেবল মনে হয়েছিল- আমার এত কাজ বাকি, কিন্তু আমি কিছুই করে যেতে পারলাম না। কীভাবে
যে প্রাণটা-
ঘটনাটা
খুলেই বলি।
বোর্গেল্ট আমাদের দুজনকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। রোবুকে সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করা সহজ নয় কিন্তু ভদ্রলোক যখন
বলছেন তখন ওকে নিয়ে যাওয়াটা স্থির করলাম। বিকেল চারটে নাগাদ রোবুকে বাক্সে
পুরে একটা ঘোড়ার গাড়ির একদিকের সীটে তাকে কাৎ করে শুইয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে, তার উলটো দিকে সীটে আমরা দুজন বসে বোর্গেল্টের
বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মাইল তিনেকের পথ, যেতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো লাগবে।
পথে যেতে
যেতে রাস্তার দুধারে বসন্তকালীন চেরি ফুলের শোভা দেখতে দেখতে পমারের কাছে বোর্গেল্টের
পূর্বপুরুষদের কথা শুনলাম। তাদের মধ্যে একজন- নাম জুলিয়াস বোর্গেল্ট-
ব্যারন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো মরা মানুষকে জ্যান্ত করতে গিয়ে
নিজেই রহস্যময়ভাবে প্রাণ হারান। এছাড়া দু-একজন উন্মাদ পুরুষদের
কথা শোনা যায় যারা নাকি বেশির ভাগ জীবনই পাগলাগারদে কাটিয়েছিলেন।
বনের ভিতর
দিয়ে পাহাড়ে রাস্তা উঠে গেছে। এখানে ঠাণ্ডাটা যেন আরো বেশি, তাছাড়া রোদও পড়ে আসছে।
আমি মাফলারটা বেশ ভালো করে জড়িয়ে নিলাম।
কিছুক্ষণ
চলার পর একটা মোড় ঘুরতেই সামনে একটা কারুকার্য করা বিরাট গেট দেখা
গেল। পমার বলল, “এসে গেছি।” গেটের উপর নকশা করে লেখা রয়েছে “ভিলা মারিয়ান।”
একজন প্রহরী
এসে গেটটা খুলে দিল। আমার গাড়ি তার ভিতর দিয়ে ঢুকে খটখট করতে করতে একেবারে
বাড়ির দরজার সামনে উপস্থিত হলো। বাড়ির চেয়ে প্রাসাদ বা কেল্লা বললেই বোধহয় ভালো। বোর্গেল্ট
সামনেই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের নামার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে তার ঠাণ্ডা হাত দিয়ে আমাদের করমর্দন করে বললেন, “তোমরা আসাতে আমি ভারি খুশি হয়েছি।”
তারপর দুজন
ষণ্ডামার্কা চাকর বেরিয়ে এসে রোবুর বাক্সটা তুলে বাড়ির ভিতরে
নিয়ে গেল। আমরা ভিতর বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম
আর তার পাশেই লাইব্রেরিতে বোর্গেল্টের আদেশ-মতো রোবুকে বাক থেকে
বার করে দাঁড় করান হলো।
সমস্ত বাড়িটা,
বিশেষ করে এই বৈঠকখানা এবং তার প্রত্যেকটি জিনিস-ছবি, আয়না, ঘড়ি, ঝাড়লণ্ঠন-
সবকিছুতেই যেমন প্রাচীনত্ব তেমনি আভিজাত্যের ছাপ। একটা কেমন গন্ধ রয়েছে ঘরটার মধ্যে
যেটা কিছুটা যেন মনে হয় কোনো ওষুধের বা কেমিক্যালের। বোর্গেল্টেরও নিজের একটা ল্যাবরেটরি নিশ্চয়
আছে আর সেটা হয়তো এই বৈঠকখানারই কাছাকাছি কোথাও হবে। বাতি জ্বালানো সত্ত্বেও ঘরের আবছা অন্ধকার ভাবটা কাটল না। কাটবেই বা কী করে,
এমন কোনো জিনিস ঘরে নেই যার রং বলা যেতে পারে হালকা। সবই
হয় ব্রাউন না হয় কালচে- আর সবই পুরনো। সব মিলিয়ে একটা গন্তীর
গা ছমছম করা ভাব।
বোর্গেল্ট
আমার জন্য গেলাসে করে আপেলের রস আনিয়ে দিল। যে চাকরটি ট্রেতে
করে পানীয় নিয়ে এলো দেখতে মনে হয় তার অন্তত নব্বই
বছর বয়স হবে। আমি হয়তো তার দিকে একটু বেশি মাত্রায়
অবাক হয়ে দেখছিলাম, আর বোর্গেল্ট বোধহয় আমার কৌতুহল মেটাবার জন্যই বললেন,
“রুডি আমার জন্মের আগে
থেকেই এ বাড়িতে আছে। ওরা তিনপুরুষ ধরে আমাদের বাড়ির চাকর।”
এখানে বলে
রাখি বোর্গেল্টের মতো এমন গন্তীর অথচ এত মোলায়েম গলার স্বর আমি আর কখনো দেখিনি।
আমরা তিনজনে
হাতে গেলাস তুলে পরস্পরের সুস্বাস্থের জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, এমন সময় বাইরে কোথা থেকে
যেন টেলিফোন
বেজে উঠল। তারপর বুড়ো চাকর রুডি এসে খবর দিল পমারের ফোন। পমার উঠে ফোন ধরতে
চলে গেলেন।
বোর্গেল্টের
হাতের গেলাসেও আপেলের রস। সেটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বোর্গেল্ট
বললেন, “প্রফেসর শঙ্কু, তুমি
জানো বোধহয়, আজ ত্রিশ বছর ধরে বৈজ্ঞানিকেরা যান্ত্রিক মানুষ নিয়ে গবেষণা করছেন।”
আমি বললাম,
“জানি।”
“এ নিয়ে কিছু কাজ আমিও করেছি তা জান বোধহয়।”
“জানি। আমি তোমার কিছু লেখাও পড়েছি।”
“আমি শেষ লেখা লিখেছি দশ বছর আগে। আমার আসল গবেষণা শুরু হয়েছে সেই
লেখার পর। এই গবেষণার বিষয় একটি তথ্যও আমি কোথাও প্রকাশ
করিনি।”
আমি চুপ
করে রইলাম। বোর্গেল্টও চুপ করে একদৃষ্টে তার কোটরগত নীল চোখ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে
রইলেন, কোথায় যেন একটা দুম্ দুম্ করে শব্দ হচ্ছে। বাড়িরই মধ্যে, কিন্তু কাছাকাছি
নয়। পমার এত দেরি করছেন কেন? উনি কার সঙ্গে টেলিফোনে কথা
বলছেন?
বোর্গেল্ট
বললেন, “পমারের ফোনটা বোধহয়
জরুরী।”
আমি চমকে
উঠলাম। আমি তো কিছু বলিনি ওঁকে। উনি আমার মনের কথা বুঝলেন কী করে?
এবার বোর্গেল্ট
একটা প্রশ্ন করে বসলেন যেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, “তোমার রোবোটটা আমার কাছে বিক্রি করবে?”
আমি অবাক
হয়ে বললাম, “সে কী কথা! কেন বলুন তো?”
বোর্গেল্ট
গন্তীর গলায় বললেন, “আমার ওটা দরকার। কারণ শুধু একটাই। আমার রোবো
অঙ্ক কষতে জানে না, অথচ ওটার আমার বিশেষ প্রয়োজন।”
“তোমার রোবো কি এখানে আছে?”
বোর্গেল্ট
মাথা নেড়ে হ্যা বললেন।
থেকে থেকে
গুম্ গুম্ গুম্ গুমূ শব্দ আর পমারের ফিরতে দেরি- এই দুটো ব্যাপারেই কেমন যেন অস্বস্থি লাগছিল। কিন্তু তা সত্বেও বোর্গেল্টের রোবো এই বাড়িতেই আছে জেনে,
আর তাকে হয়তো দেখতে পাব এই মনে করে একটা উত্তেজনার শিহরণ অনুভব
করলাম।
“আমি-গটফ্রীড বোর্গেল্ট- যা সৃষ্টি করেছি তার কোনো তুলনা নেই। কিন্তু
আমার রোবোর একটি গুণের অভাব। সে তোমারটার মতো অত সহজে অঙ্ক কষতে পারে না। অথচ তার এই অভাব পূরণ করা দরকার।
তোমার রোবোটা পেলে সে কাজটা সম্ভব হবে।”
আমার ভারি
বিরক্ত লাগল। এমন জিনিস কি কেউ কখনো পয়সার জন্যে হাতছাড়া করে? আমার এত সাধের
নিজের হাতে তৈরি প্রথম রোবো- এটা আমি হাইডেলবার্গের
আধপাগলা বৈজ্ঞানিকের কাছে বিক্রী করে দেবো? কিসের জন্য?
আমার এমন কি টাকার দরকার পড়েছে। আর ওই অঙ্কের ব্যাপারটাতেই তো আমার
সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। বোর্গেল্ট যেমন রোবোই তৈরি করে থাকুন না কেন, উনি নিজে যাই বলুন, আমি
জানি আমার চেয়ে আশ্চর্য যান্ত্রিক মানুষ তিনি কখনোই তৈরি করেননি।
আমি মাথা
নেড়ে বললাম, “মাপ করো বোর্গেল্ট। ও-জিনিসটা আমি বেচতে পারব না। সত্যি বলতে কি,
তুমি যখন এত বড় বৈজ্ঞানিক তখন আরেকটু পরিশ্রম করলে আমি যে জিনিসটা করেছি সেটা তুমি করতে
পারবে না কেন?'
“তার কারণ-” বোর্গেল্ট সোফা ছেড়ে
উঠে দাঁড়িয়েছেন- “সবাই সব জিনিস পারে
না। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। চেষ্টা করলে যে পারি তা আমিও জানি, কারণ
আমার অসাধ্য কিছু নেই। কিন্তু সময় কম। আমার টাকা-পয়সাও যা ছিল সবই
গেছে। আমার বাড়ি দেনার দায়ে বাধা পড়ে আছে। সব কিছু গেছে আমার ওই
একটি রোবো তৈরি করতে। কোটি কোটি মার্ক খরচ করেছি আমি ওটার পিছনে। কিন্তু ওই একটা গুণের
অভাবে ওটা নিখুঁত হয়নি। ওটা আমার চাই। ওটা পেলে আমি আমার রোবো থেকেই আমার সমস্ত টাকা
আবার ফিরে পাবো। লোকে বলবে, হ্যা বোর্গেল্ট যা করছে তার বেশি কিছু করা মানুষের সাধ্য
নয়। আমার সিন্দুকে কিছু সোনার গোল্ড রাখা আছে- চারশো বছরের পুরনো।
সে গোল্ড আমি তোমাকে দেবো,
তুমি রোবোটা
বিক্রী করে দাও।”
সোনার লোভ
দেখাচ্ছেন আমাকে! লোভ জিনিসটা যে কতকাল আগে জয় করেছি তা তো আর বোর্গেল্ট
জানেন না! এবার আমিও আমার গলার স্বর যথাসম্ভব গন্তীর করে বললাম, “তোমার কথাবার্তার সুর
আমার ভালো লাগছে না, বোর্গেল্ট। সোনা কেন- হীরের খনি দিলেও আমার রোবুকে বিক্রী করব না।”
“তাহলে আর তুমি কোনো
রাস্তা রাখলে না আমার জন্য!”
এই বলে
বোর্গেল্ট প্রথমে যে কাজটা করলেন সেটা হলো সোজা গিয়ে সিঁড়ির
দিকের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া। তারপর উল্টো দিকে যে দরজাটা ছিল বোধহয়
খাবার ঘরে যাবার- সেটাও সে বন্ধ করে দিল, কাচের জানালাগুলো
এমনিতেই বন্ধ। খোলা রইল শুধু লাইব্রেরির দরজা। রোবু রয়েছে ওই লাইব্রেরি ঘরে,
আর এই প্রথম আমার মনে হলো যে, আমি হয়তো আর রোবুকে দেখতে পাব না। হয়তো সে আর কয়েকদিনের
মধ্যেই অন্য মালিকের হয়ে কাজ করবে, তার হয়ে কঠিন কঠিন অঙ্কের সমাধান করবে। আর
পমার? আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, পমারের সঙ্গে বোর্গেল্ট ষড়যন্ত্র করে আমার
সর্বনাশ করতে চলেছে।
দুম দুম্
দুম দুম আবার সেই শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হয় মাটির নিচ থেকে আসছে সে শব্দটা। কিসের
শব্দ? বোর্গেল্টের রোবো?
আর ভাববার
সময়, নেই। বোর্গেল্ট আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আবার সেই
নিষ্পলক দৃষ্টি এমন নিষ্ঠুর চাহনি আমি আর কারো চোখে দেখিনি।
এবার যখন
বোর্গেল্ট কথা বললেন তখন দেখলাম তার গলায় আর সে মোলায়েম ভাবটা নেই। তার বদলে
একটা আশ্চর্য ইস্পাতসুলভ কাঠিন্য।
“প্রাণ সৃষ্টি করার চেয়ে প্রাণ ধ্বংস করা কত বেশি সহজ সেটা তুমি
জানো না শঙ্কু?” গলার স্বর বন্ধ ঘরে
গম গম করে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। “একটি মাত্র ইলেকট্রিক
শক! কত ভোল্টেজ জানো? তোমার রোবু জানতে পারে। আর
সে শক্ দেওয়ার পন্থাটিও ভারি সহজ...”
আমার গায়ে
সেই শক্ রোধ করা কার্বোথিনের গেঞ্জিটা পরা আছে। শক্-এ আমার কিছু হবে না। কিন্তু
গায়ের জোরে এই জার্মানদের সঙ্গে পারব কী করে?
আমি চিৎকার
করে উঠলাম-“পমার! পমার! পমার!”
বোর্গেল্ট
তার ডান হাতটাকে সামনে বাড়িয়ে পাঁচটা আঙুল সামনের দিকে
সোজা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তার চোখে হিংস্র উল্লাসের
দৃষ্টি।
আমি পেছোতে
গিয়ে সোফায় বাধা পেলাম। পেছানোর কোনো উপায় নেই। বোর্গেল্টের
হাতের আঙুল আমার কপাল থেকে ছ’ইঞ্চি দূরে। ঢাকার
কথা-
ঠৎ ঠং ঠং
ঠং-
একটা শব্দ
শুনে আমার দৃষ্টি ডান দিকে ফিরল। বোর্গেল্টও যেন চমকে দিয়ে ঘাড় ফেরালেন। তারপর এক
আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটল। ল্যাবরেটরির দরজা দিয়ে আমাদের ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত
হলো আমারই হাতের তৈরি যান্ত্রিক রোবু। তার চোখে এখনো ট্যারা,
তার মুখে এখনো আমারই দেওয়া হাসি।
চোখের নিমেষে
একটা ইস্পাতের ঝড়ের মত এগিয়ে এসে তার হাত দুটোকে বাড়িয়ে দিয়ে জাপটে ধরল
বোর্গেল্টকে।
আর তারপর
যেটা ঘটল সে রকম বিচিত্র বীভৎস জিনিস আমি আর কখনো দেখিনি।
রোবুর হাতের
চাপে বোর্গেল্টের মাথাটা যেন প্যাচের মতো একেবারে পিঠের দিকে ঘুরে গেল। তারপর রোবুর
টানে সেই মাথাটা শরীরের ভিতর থেকে একেবারে আলগা হয়ে গিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল, আর শরীরের
ভিতর থেকে গলার ফীক দিয়ে বেরিয়ে পড়ল এক রাশ বৈদ্যুতিক তার।
আমি আর
দাড়িয়ে থাকতে না পেরে প্রায় অবশ অচেতন অবস্থায় ধপ করে
সোফায় বসে পড়লাম। চোখ, মন, মস্তিষ্ক সব যেন ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।
প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় বুঝতে পারলাম সিঁড়ির দিকের দরজায় ধাক্কা পড়ছে।
শঙ্কু,
দরজা খোল- দরজা খোল!?
পমারের
গলা।
হঠাৎ যেন
আমার শক্তি আর জ্ঞান ফিরে পেলাম। সোফা ছেড়ে উঠে
দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি তিনজন লোক- পমার, বোর্গেল্টের
বুড়ো চাকর রুডি, আর- হ্যা, কোনো সন্দেহ নেই- ইনি হলেন আসল বৈজ্ঞানিক
গটফ্রীড বোর্গেল্ট।
এর পরের
ঘটনা আর বেশি নেই। আমার মনের কয়েকটা প্রশ্নের মধ্যে একটা পমারের কথায় মুহূর্তেই পরিষ্কার
হয়ে গেল।
“সেদিন মাঝ রান্তিরে আমি ল্যাবরেটরিতে ঢুকে তোমার রোবুর মাথার ভিতর
আমারই আবিষ্কৃত একটা যন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। তার ফলে
তোমার সঙ্গে ওর মনের একটা টেলিপ্যাথিক যোগ হয়ে গিয়েছিল।
তোমার বিপদ বুঝে তাই আর ও চুপ করে থাকতে পারেনি।
বোর্গেল্ট
বললেন, “এসব যান্ত্রিক মানুষ
যন্ত্রের মতো হওয়াই ভালো। আমার রোবোকে আমি এত বেশি আমার
মতো করে ফেলেছিলাম বলেই ও আর আমাকে সহ্য করতে পারল না। ঠিক ওরই মতো আরেকজন
কেউ থাকে ও চাইল না। ভেবেছিলাম আমার মৃত্যুর পর ও আমার কাজ চালিয়ে যাবে, কিন্তু ব্রেন
জিনিসটার মতি-গতি কী আর মানুষে স্থির করতে পারে? যেই ওর বাধন খুলে দিলাম, অমনি ও আমাকে
বন্দী করে ফেলল। আমাকে মারেনি, তার কারণ ও জানত যে বিগড়ে গেলে আমি ছাড়া ওর গতি নেই।
পমার বললেন,
“রুডি সবই জানত- কিন্তু
ভয়ে কিছু করতে পারছিল না। আজকে ফোনের ধাপ্পাটা রুডিরই
কারসাজি। ও চেয়েছিল আমাকে বাইরে এনে বোর্গেল্টের বন্দী হওয়ার কথাটা বলে আর তারপর দুজনে
মিলে তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে। সেই ফাকে যে তোমার জীবন এইভাবে বিপন্ন হবে তা আমি ভাবতে
পারিনি।
একটা জিনিস
হঠাৎ বুঝতে পেরে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। বললাম, “রোবু সেদিন বোর্গেল্টের নাম
কেন বলেনি বুঝতে পারছ তো? যে আসলে বোর্গেল্ট নয়, তার নাম বোর্গেল্ট ও কী করে বলবে? আমরা
বুঝিনি, কিন্তু ও ঠিক বুঝেছিল। যন্ত্রই যন্ত্রকে চেনে ভালো।”
- - - - - - - - - - - - - - - - - শেষ - - - - - - - - - - - - - - - - - মারুফ আল মাহমুদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন