সাইকো সার্জারি,মনের অস্ত্রোপচার,মগজ ধোলাই, Psychosurgery,Egas Moniz |
জামালের কথার কোনো নড়চড় হলেই সে রেগে যায়। অনেক সময় সে নিজেকে শান্তও করতে পারে না। বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে সকলেই তার এই ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করে না। জামাল নিজেও এ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। হঠাৎই একদিন তার চোখ পড়ে খবরের কাগজের একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের দিকে। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘রাগ ও উত্তেজনা কমানোর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি’। চটজলদি সে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যায়। চিকিৎসক তাকে একটি ছোট অস্ত্রেপচারের কথা বলে। ভাস্কর তাতেই রাজি হয়। যথাসময়ে অপারেশন হয়। সুস্থ্য হয়ে যখন সে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ফিরে আসে তখন সে এক নতুন মানুষ। একটুও রাগ নেই। শান্ত শিষ্ট ...।
আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি নিশ্চয়ই আপনাদের কোনো রূপকথা বা কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলছি। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এটা নিছক ভুয়া কথা। ছুরি, কাঁচি দিয়ে মনের গতিবিধি কাটা ছাটা করার কথা কি ভাবা যায়? প্রিয় পাঠক, এটা কোনো গল্প নয়। এটা সত্যি। এ প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এক আধুনিকতম বিস্ময়। একে ইংরেজিতে বলা হয় সাইকো সার্জারি (Psychosurgery) বাংলায় বলা যায় ‘মনের অস্ত্রোপচার’ আবার রঙ্গ করে বলতে পারেন মগজ ধোলাই। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের টেস্ট টিউব শিশুর খবর কিংবা মঙ্গলে প্রাণের সন্ধান খবরের ঝাঁজ অনেক কমে যায়। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপার নিয়ে নোবেল পুরস্কার দিতেও কার্পণ্য করা হয়নি পঞ্চাশের দশকে। কিন্তু তারপর বেশ কিছু প্রতিকূলতা ও নীতিগত বাদানুবাদে এই গবেষণা কিছুটা থমকে গিয়েছিলো। তাই বলে কিন্তু আদৌ গবেষণা বন্ধ হয়নি, গোপনে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয়েছে তবে সেই গবেষণার কালানুক্রমিক অগ্রগতির খবর বিস্তারিতভাবে বলা খুবই শক্ত। তবে গোপন খবর যা পাওয়া যাচ্ছে। তাতেই আমাদের ভিরমি খাওয়ার যোগাড়।
প্রাচীন রোমে একদা একটি প্রবাদবাক্য প্রচলিত ছিলো—কপালে তলোয়ারের ঘা খেলে পাগলামি ছুটে যাবে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে রোমানদের এই বিশ্বাস দানা বেঁধে ছিলো তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তবে এর কয়েক বছর আগেই দু’জন শারীরবিজ্ঞানী ভি. বি. মাইন্টক্যাসেল ও পি. বার্ড বেড়ালের প্রায় পুরো ঘিলুটাই সরিয়ে ফেলেছিলেন, বাকি রেখেছিলেন শুধু সেইটুকু অংশ যেখানে মেরুদণ্ড গিয়ে শেষ হয়েছে (অ্যামিগডালয়েড)। দেখা গেলো বিড়াল দিব্যি বেঁচে আছে, খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ব্যতিক্রম একটাই— কিছুতেই বিড়ালের রাগ হচ্ছে না। না, ভিজে বিড়াল নয়, হাজার উত্যক্ত করলেও সত্যি সত্যি তাকে খ্যাপানো যাচ্ছে না, সব সময় শান্ত শিষ্ট ও ধীরস্থির হয়ে আছে।
এরপরই চমক জাগালো জেমস ফুলটন-এর সেই বিখ্যাত গবেষণা। বেকি আর লুসি নামে ২টি শিম্পাঞ্জি ছিলো ভয়ানক দুরন্ত আর রাগী। সব সময়ই আচড়ানো আর খামচানোর চেষ্টা করতো। ফুলটন ওদের সামনের মস্তিষ্কের একটি স্নায়ুগুচ্ছ কেটে ফেলে দিলেন। সুস্থ হওয়ার পর দেখা গেলো, প্রায় সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে, এমনকি স্মৃতিশক্তিও অটুট আছে। কিন্তু তাদের আগেকার ক্রোধ অস্তমিত একেবারে পরম প্রভুভক্ত। খবরটা কানে গেলো আর এক বিজ্ঞানীর। তার নাম ড. এগাস মোনিজ। তার মাথায় খেলে গেলো যে, মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দেখলে তো মন্দ হয় না। কারণ মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের স্নায়ুগুচ্ছে তো অনেক মিল! ব্যস, যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। তিনি লিসবনের পাগলাগারদ থেকে নির্বাচন করলেন ৬৩ বছর বয়স্ক এক বিকৃত মস্তিষ্কের বৃদ্ধাকে। সাফল্য এলো অপ্রত্যাশিতভাবে। উৎসাহের জোয়ারে আরো ১৯ জন পাগল তার পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিয়ে প্রায় স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। সব ক্ষেত্রেই মূল কাজটা ছিলো মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ স্নায়ুগুচ্ছ কেটে বাদ দেয়া। হু হু করে ছড়িয়ে পড়লো এই অত্যাশ্চার্য ঘটনার কথা। পরীক্ষার সুদূরপ্রসারী উপযোগিতা ও পরিণতি কাপিয়ে দিলো নোবেল কমিটিকে। আর ড. মোনিজ পেয়ে গেলেন নোবেল পুরস্কার।
সাইকো সার্জারি,মনের অস্ত্রোপচার,মগজ ধোলাই, Psychosurgery,Egas Moniz |
সাইকো সার্জারির অন্যতম পথিকৃত পর্তুগীজ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. এগাস মোনিজ (Egas Moniz. Antonio (১৮৭৪-১৯৫৫))।
আমাদের মস্তিষ্ক অজস্র অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত। কোনো অঞ্চল শাসন করে অঙ্গচালনা, কোনো অঞ্চল খবরদারি করে চিন্তা শক্তির, কোনো অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে আবেগ, আবার কোনো অঞ্চল ধরে রাখে স্মৃতিশক্তি। চিন্তাশক্তির অঞ্চল (সামনের মস্তিষ্ক) ও আবেগের অঞ্চল (মধ্য মস্তিষ্কের নিচের দিকে হাইপোথ্যালামাস নামক জায়গা) সংযুক্ত করে রয়েছে যে স্নায়ুগুলো তার কয়েকটিকে কেটে ফেলাই সাইকো সার্জারির মূল উদ্দেশ্য। এই তত্ত্ব হাতে নিয়ে আসরে নামলেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নিউরোলজিস্ট ওয়াল্টার ফ্লিম্যান ও জেমস ওয়াট। তারা দেখলেন আবেগের যত কিছু বাড়াবাড়ি দমন করতে পারে এই অস্ত্রোপচার। ফলে, তারা ভ্রু’র নিচে এবং নাকের কাছে ঘেঁষে সরু কাঁচি ঢুকিয়ে কচ কচ করে কেটে দিতে লাগলেন বহু খুনী ও পাগলের মস্তিষ্কের এই সংযোগ সেতু। দুঃখের বিষয়, কার্যক্ষেত্রে দাঁড়ালো অন্য সমস্যা। মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো এত সরু আর কাছাকাছি যে ঐ সংযোগ সেতু ছিন্ন করতে গিয়ে অন্য অনেক প্রয়োজনীয় স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো বা কিছু অবাঞ্ছিত স্নায়ু অক্ষুন্ন রয়ে যাচ্ছিলো। ফলে, অস্ত্রপচারের পর অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হতেও দেখা গেলো যেমন, রোগীর আলস্য বেড়ে গেলো। সে অতি প্রাকৃত দৃশ্য দেখতে লাগলো বা জবুথবু স্বভাবের হয়ে গেলো। যদিও এখনও এর পুরো সমাধান পাওয়া যায়নি, তবু ইতিমধ্যে আট রকম অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়ে গেছে, যাতে আরও সূক্ষ্মভাবে স্নায়ুগুলোকে নির্দিষ্ট করা যায়। সম্প্রতি সাইকো সার্জারির দু’জন প্রধান প্রবক্তা নিউজিল্যান্ডের ড. মারে এ. ফ্যালকোনার ও মিসিশিপির ড, অরল্যাণ্ডো জে. অ্যান্তি জোরগলায় দাবি করেছেন যে তাদের অন্তত শতকরা ৮০টি অস্ত্রোপচার নিখুঁত। সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে আবেগপ্রবণ অসামাজিক মনোবৃত্তি চিরতরে দমন করার এক অভিনব উপায় হাতে এলো বলে। এখন হয়তো অপরাধীর শাস্তি হবে না, চিকিৎসা হবে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন নিয়ে সারা পৃথিবীতে বিতর্কের ঝড় উঠেছে এই সুদূরপ্রসারী গবেষণার দাম বেশি, না ব্যর্থ অস্ত্রোপচারের বলি হয়ে যারা ভুগবেন তাদের জীবনের দাম বেশি? এই দুই মতের কোনোটিকেই এখনই চট করে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না, তাই সাইকো সার্জারি বা মগজ ধোলাই এখন আবাহন ও বিসর্জনের দুই নৌকায় পা দিয়ে দুলছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন