লাল চাল,বেরিবেরি রোগ, ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) আবিষ্কার,Red rice,beriberi disease,Discovery of vitamin B1 (thiamine),বিজ্ঞানী রবার্ট উইলিয়ামস, |
লাল চাল, বেরিবেরি রোগ ও ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) আবিষ্কার - Red rice, beriberi disease and Discovery of vitamin B1 (thiamine)
চকচকে হীরে-জহরত বা সোনা দেখলে কচি শিশুর চোখও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লোভীর চোখে জ্বলে আগুন। কিন্তু মণি-মানিক কখনো থাকে মাটিতে ঢাকা। তখন হাতে পেলেও আমরা অনেক সময় তাকে চিনতে পারি না।
ছেলেবেলার একটি দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে ভাসে।......গ্রামে থাকি, শহরে পড়ি। বিকেলবেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি একটা বাড়ির দরজার কাছে পথের পাশে একগাদা ভাত পড়ে রয়েছে। মনে হল, ভাত তো নয় যেন ধবধবে সাদা একরাশ ফোটা বেলফুলের স্তুপ।
সে ১৯৪২ সালের শেষ। তখন দেশে চলছে মহাযুদ্ধ, আর মহাদুর্ভিক্ষ। ভাতের জনো চারদিকে মানুষের হাহাকার। রাস্তার ধারে এতগুলো ভাত পড়ে থাকতে দেখে অবাক লাগল। কিন্তু তার চেয়েও অদ্ভুত লাগল ভাতগুলো এমন আশ্চর্য রকম সাদা! চারপাশের নোংরার মধ্যে যেন উজ্জ্বল শুভ্রতায় চিকচিক করে জ্বলছে। .......তারপর বহু বছর কেটে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য, এমন সাদা ভাত আর কখনো আমার চোখে পড়েনি।
এই ঘটনার বছর কুড়ি আগে এমনি সাদা ভাত ভাবিয়ে তুলেছিল রবার্ট উইলিয়ামস (Robert Runnels Williams) নামে এক বিজ্ঞানীকে। উইলিয়ামস জাতে মার্কিন হলেও জন্ম তার দক্ষিণ ভারতে। ছোটবেলায় তার পাদরি বাপের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন ভারতের নানা জায়গায়। সেখানে তিনি দেখেছিলেন দুর্ভিক্ষের করাল মূর্তি আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিবেরি রোগে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু। বড় হয়ে রসায়নবিদ হিসেবে কাজ শুরু করলেন তিনি ফিলিপাইনের কৃষি বিভাগে। সেখানেও তিনি দেখলেন দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ আর বেরিবেরি রোগ।
একটা জিনিস উইলিয়ামসের চোখে পড়ল। শুধু শহুরে লোক নয়, ফিলিপাইনের যারা গরিব লোক, গায়ের চাষি,তারাও পছন্দ করে সাদা চালের ভাত। লাল চালের চেয়ে সাদা চালের দাম বেশি। তারপরও গরিব লোকেরা কেনে সাদা চাল —যার ভাত হয় ফরসা ধবধবে, সুন্দর।
বেরিবেরি রোগ নিয়ে উইলিয়ামস নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। এই রোগের প্রথম লক্ষণ হল শারীরিক দুর্বলতা; পা ভারী হয়ে আসে, হাত-পা অবশ আর ঝিনঝিন বোধ হয়। তারপর দু'ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এক হল রসালো বেরিবেরি দম নিতে কষ্ট হয়, বুক ধড়ফড় করে। গায়ে পানি জমে। হাত পা দারুণ ফুলে ওঠে। আর এক হল শুকনো বেরিবেরি। এতে ক্রমে ক্রমে হাত পায়ের মাংসপেশি শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে ওঠে, আঙুলের ডগায় অনুভূতি-শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। শ্বাসকষ্ট হয়; মুখ আর নাকের পাশে নীল হয়ে ওঠে। অবশেষে একদিন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগী মারা যায়।
শিশুদের মধ্যে বেরিবেরির ফল হয় মারাত্মক। ফিলিপাইনে শিশুদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই মারা পড়ত এইভাবে। উইলিয়ামস দেখলেন, বিশেষ করে মারা পড়ে যেসব শিশু তোলা-দুধ না খেয়ে মায়ের বুকের দুধ খায় তারা। তিনি ভাবলেন, তাহলে কি মায়ের দুধে কোনো উপাদানের অভাব ঘটছে যার জন্যে শিশুরা সেই দুধ খেয়ে বেরিবেরিতে আক্রান্ত হয়?
অনেক দেখেশুনে উইলিয়ামসের মনে হল সাদা চালের ভাত আর বেরিবেরির মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু সম্বন্ধ আছে। হয়তো চালের ওপরকার লাল আবরণের মধ্যে এমন কোনো উপাদান রয়েছে যা বেরিবেরি প্রতিরোধ করে। বেশি করে ছাটা সাদা চালে সেই উপাদানটি থাকে না। তাই সাদা চাল খায় যে-মায়েরা, তাদের বুকের দুধ খেলে ছেলেমেয়েদেরও বেরিবেরি হয়। সাদা চালের সঙ্গে যে বেরিবেরি রোগের সম্বন্ধ থাকতে পারে সেটা এর ক'বছর আগে এক ওলন্দাজ বিজ্ঞানীও অনুমান করেছিলেন। ক্রিস্টিয়ান আইজম্যান (Christiaan Eijkman) নামে এই ডাক্তার ইন্দোনেশিয়ায় মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন বেরিবেরি রোগের কারণ খুঁজতে। তখনকার দিনে মনে করা হত সব রোগেরই কারণ হল কোনোরকমের জীবাণু। কিন্তু বেরিবেরির জীবাণু আর তিনি খুঁজে পান নাই। অবশেষে ১৮৯৬ সালে এক আকস্মিক ঘটনায় তিনি এক নতুন কারণ অনুমান করলেন।।
তার গবেষণাগারে মুরগির বাচ্চা দিয়ে নানারকম গবেষণা করা হত। একদিন দেখা গেল পরীক্ষার জন্যে রাখা মুরগির বাচ্চাদের মধ্যে বেরিবেরির মড়ক লেগেছে। অমনি আইকমান এইসব অসুস্থ বাচ্চাকে ধরে বেরিবেরির জীবাণুর খোজে লেগে গেলেন ; রুগ্ন বাচ্চা থেকে সুস্থ বাচ্চার শরীরে রোগ ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু আশ্চর্য! জীবাণুর কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। তারপর তিনি একদিন অবাক হয়ে দেখলেন, প্রায় ভোজবাজির মতো সব বাচ্চার বেরিবেরি সেরে গিয়েছে। তিনি মস্ত এক ধাঁধায় পড়লেন।
শেষটায় খোঁজ করতে করতে আইকম্যান দেখলেন, মাঝখানে কিছুদিন হাসপাতালের বাবুর্চি চুপিচুপি রোগীদের পথ্যের জন্যে রাখা সাদা চাল মুরগির বাচ্চাদের খাওয়াতে শুরু করেছিল। যখন বাচ্চাদের জন্যে সাদা চালের টান পড়ে যায়, তখন তাদের অসুখও ভাল হয়ে যায়। এই প্রথম আইকম্যানের কাছে মনে হল, তা হলে এমন রোগও থাকতে পারে যা জীবাণু থেকে হয় না, খাবারে কোনো উপাদানের অভাব থেকে হয়। এরপর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় তিনি দেশে ফিরতে বাধ্য হন। তাঁর গবেষণাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। খাবারে ঠিক কোন উপাদানের অভাব। হলে বেরিবেরি হয় তা তিনি বের করতে পারেননি। সে-ভার এসে পড়ে উইলিয়ামসের ওপর।
কিন্তু শুধু অনুমান করলে তো হবে না, সাদা চালে কোন উপাদানের অভাবে বেরিবেরি হয় তা পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করতে হবে। লাল চালের খোসাতেই কি রয়েছে এই উপাদান? কয়েকজন ডাক্তার-বন্ধুর সঙ্গে মিলে উইলিয়ামস চাল-ছাঁটা লাল আবরণের এক নির্যাস তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম একে ব্যবহার করা হল বেরিবেরি রোগগ্রস্ত কুকুরছানার ওপর। তাতে ভাল ফল পাওয়াতে তখন প্রয়োগ করা হল মানুষের ওপর। দেখা গেল জটিল বেরিবেরি কিছুদিন এই নির্যাস ব্যবহার করলে সেরে যায়।। কয়েকটি শিশুকে কঠিন বেরিবেরিতে এই নির্যাস খাইয়ে নাটকীয় ফল পাওয়া গেল। এই ওষুধ খাওয়ার মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই থেমে গেল শিশুর প্রায়-শব্দহীন একটানা অস্থির গোঙানি; তারপর কমে এল দম-আটকানো শ্বাসটানা; শান্ত হল নাড়ির এলোমেলো ওঠানামা; স্বাভাবিক হয়ে এল নীল হয়ে ওঠা ঠোঁটের রঙ।
কিন্তু লালচাল-ছাঁটার মধ্যে কী এমন জিনিস আছে যা বেরিবেরি ঠেকাতে পারে? কেনই-বা এর অভাবে বেরিবেরি হয়? এসব কথা জানা গেল আরও পরে। জিনিসটির নাম দেওয়া হল ভিটামিন বি (এক)। আরও জানা গেল চাল-ছাঁটা লাল আবরণের মধ্যে এই ভিটামিন রয়েছে অতি সূক্ষ্ম মাত্রায় পঞ্চাশ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। একজন বলিষ্ট লোকের সারা শরীরে এর পরিমাণ মাত্র এক তোলার পাঁচশত ভাগের এক ভাগ। অথচ এই সামান্য পরিমাণ ভিটামিনও আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যে অপরিহার্য। শরীরে এর অভাব বা কমতি হলে নানারকম রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। বেরিবেরি ছাড়াও এর অভাবে হয় নানা জাতের স্নায়বিক রোগ, আর মানুষ তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায়।
লাল চাল,বেরিবেরি রোগ, ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) আবিষ্কার,Red rice,beriberi disease,Discovery of vitamin B1 (thiamine),বিজ্ঞানী রবার্ট উইলিয়ামস,
জিনিসটির গুরুত্ব বুঝে এর পর দুনিয়ার নানা দেশের বিজ্ঞানীরা এবার ভিটামিন বি১ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। বহু বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলে পানিতে এই ভিটামিনের অপেক্ষাকৃত গাঢ় দ্রবণ পাবার উপায় জানা গেল। তারপর ১৯৩৩ সালে মাত্র কয়েক কণা বিশুদ্ধ ভিটামিন বি১ পৃথক করা সম্ভব হল। ১৯৩৪ সালে উইলিয়ামস প্রায় ৩০ মণ লাল আবরণ থেকে এক তোলা ভিটামিন বের করার কায়দা আবিষ্কার করলেন।
এবার বিজ্ঞানীদের চেষ্টা হল এই ভিটামিনের রাসায়নিক গুণাগুণ পরীক্ষা করা। কী কী মৌলিক পদার্থে এটা তৈরি তার রহস্য বের করা দরকার। কথাটা শুনতে যত সহজ আদতে কাজে মোটেই অত সহজ নয়। প্রথমত, একে আগে অতি বিশুদ্ধ আকারে সংগ্রহ করতে হবে, তা নইলে রাসায়নিক অবস্থা মোটেই শুদ্ধভাবে জানা যাবে না। দ্বিতীয়ত, এই জটিল রাসায়নিক অণুর প্রকৃতি জানতে হলে তাকে ভেঙে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট অণুতে ভাগ করে নিতে হবে। দিনরাত প্রাণপণ পরিশ্রম করে অবশেষে বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেকার কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, গন্ধক প্রভৃতি পরমাণুর সংখ্যা বের করতে পারলেন। ভিটামিনটির রাসায়নিক নাম দেওয়া হল থায়ামিন। রাসায়নিক স্বরূপ জানার পরে বিজ্ঞানীদের সমস্যা হল কী করে ভিটামিনকে পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা যায়। কৃত্রিম উপায়ে এই ভিটামিন তৈরি করা সম্ভব হলে মানুষের স্বাস্থ্য সাদা চাল লাল চালের ওপর নির্ভর করবে না, আর মায়ের বুকের দুধ খেয়েও শিশুরা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে না। তখন দেহে উপযুক্ত পরিমাণে ভিটামিন সরবরাহ করা হবে সম্পূর্ণ মানুষের আয়ত্তে।
উইলিয়ামসের বহু দিনের চেষ্টা একদিন সার্থক হল। ১৯৩৬ সালে তিনি সামান্য এক কণা বিশুদ্ধ থায়ামিন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করতে সক্ষম হলেন। এই এক কণা থায়ামিনের বেরিবেরি প্রতিরোধ ক্ষমতা বিরাট এক স্তুপ চাল-ছাটা লাল আবরণের সমান।।
এতদিনের চেষ্টায় বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে যে সামান্য পরিমাণ থায়ামিন তৈরি হল, তাকে ক্রমে ক্রমে ব্যাপক আকারে কারখানায় তৈরির পদ্ধতিও আবিস্কৃত হল। এবার আর ভিটামিন বি (এক)-এর অভাবে কারও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা নয়। কেননা এমন অবিশ্বাস্য রকম কম খরচে একে কারখানায় তৈরি করা যায় যে, বাজারে ছাড়বার আগে ময়দায়, রুটিতে, চালে একে মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব (বিদেশে এর মধ্যেই তা হচ্ছেও)।
শুধু ভিটামিন বি১ নয়, এমনি প্রায় গোটা কুড়ি ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণের কথা আজ জানা গেছে। এগুলি দেহের পরিপুষ্টির জন্যে অবশ্য প্রয়োজন। আর তার মধ্যে গোটা দশেকই রাসায়নিক উপায়ে কারখানায় তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। যেমন, বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের দেহ বাড়বার জন্যে এবং চোখের স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত দরকারি ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ (কড-লিভার তেলে যা প্রচুর পাওয়া যায়); সুঠাম স্বাস্থ্য ও ক্ষয় প্রতিরোধের জন্যে দরকারি ভিটামিন ‘সি’ (বাতাবি আর লেবুতে রয়েছে প্রচুর); দেহের বৃদ্ধি ও দীর্ঘজীবনের জন্যে দরকারি ভিটামিন বি (দুই), যা টাটকা শাকসবজিতে রয়েছে- এগুলো সবই আজ রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে। আর তাই সস্তায় ভিটামিনের বড়ি বা ভিটামিনজাত ওষুধ আজ সহজেই পাওয়া যায়।
কিন্তু এসব ভিটামিন কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হচ্ছে বলেই যে আমরা প্রাকৃতিক ভিটামিনকে নষ্ট করব তার কোনো মানে নেই। টাটকা শাকসবজির বদলে বাসি শাকসবজি খেয়ে তারপর ভিটামিন গেলার কোনো অর্থ হয় কি? ভিটামিনওয়ালা অল্প ছাটা চালের বদলে ফরসা ধবধবে চাল ব্যবহার করাও অনেকটা তেমনি। এও কি হাতের কাছে সোনা পেয়ে তাকে পায়ে ঠেলে দেবার মতোই নয়?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন