বুধবার, ২১ জুলাই, ২০২১

সায়েন্স ফিকশন ছিনতাই - Science Fiction - Chintai

Science Fiction,সায়েন্স ফিকশন,বিজ্ঞান কল্পকাহিনী,

 

সায়েন্স ফিকশন ছিনতাই -  Science Fiction - Chintai

দরজাটা ছিল বাইরে থেকে তালামারা। স্টার অব দ্য নর্থ মহাকাশযানের ট্যুরিস্ট কেবিনে আটকা পড়ে আছে কাল্লি। লম্বামুখো স্টুয়ার্ডটা ওকে কোন সুযোগই দেয়নি। কাল্লি আসলে বুঝতেই পারেনি ওকে এধরনের ফাদে ফেলা হবে। বেসিনের আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। অবশ্য কেউ যদি এখন তার আশেপাশে থাকত এভাবে দাঁত বের করে হাসবার কথা সে চিন্তাও করত। তার এই হাসির অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে। তবে তার মন খুব কঠিন। এই মুহুর্তে নিজের সঙ্গে তামাশা ছাড়া এই হাসির আর কি অর্থ হতে পারে? বিছানার উপর বসল কাল্লি। পুরু বিছানার একপাশটা সাঁই করে উপরে উঠে গেল। দরজার হাতলটা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেল। দারুণ জিনিস বানিয়েছে বটে। কিন্তু এমন অসতর্ক সে হলো কিভাবে? নাকি টের পেয়ে গিয়েছিল ওরা? প্রথমেই ওকে চিনে ফেলেছিল?
আমি দুঃখিত, স্যার, কাল্লি যথন স্লাইডিং ডোর খুলে বিছানাটা অগোছাল দেখল, তখন স্টুয়ার্ডটা বলেছিল ওকে। আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।
তাড়াহুড়োর দরকার নেই, কালি বলেছিল। আমি শুধু আমার কাপড়গুলো ঝুলিয়ে রাখতে চাই। অবশ্য সেটা পরেও করা যেতে পারে।
ওহ, না, স্যার,' বলেছিল পাতলা, জেদি, লম্বামুখো লোকটা। 'ওভার ড্রাইভের আগেই যাত্রীদের মালপত্র ও বিছানা ঠিকঠাক করে দেয়া হয়।
ভাল কথা। কিন্তু করিডরে শুধু শুধু এভাবে দাড়িয়ে থাকতে পারব না। একটা ড্রিঙ্ক দাও আমাকে।
মাত্র কিছুক্ষণ, স্যার, স্টুয়ার্ড বলেছিল, এখনি নতুন চাদর নিয়ে আসছি আমি। পরে বিছানায় হেলান দিয়ে আরাম করে ড্রিঙ্ক করবেন। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আপাতত ভেতরে বসুন, স্যার! চাদর ছাড়া বিছানায়
বসতে নিশ্চয় আপত্তি নেই? আমি এই এলাম বলে......
কিন্তু তাড়াতাড়ি...
সে আর বলতে!
তখন বিছানায় গিয়ে বসেছিল কাল্লি এবং মুহর্তে বিছানার একটা দিক উপরে উঠে গিয়েছিল। পেছনের দিকে হেলে পড়েছিল সে। পা দুটো উঠে গিয়েছিল শূন্যে।
মাফ করবেন, স্যার, স্টুয়ার্ড দরজার বাইরে থেকে খিকখিক করে হেসে উঠেছিল।
ঠেলে বন্ধ করে দিয়েছিল দরজাটা। পরক্ষণেই দরজায় তালা মারার শব্দ শুনতে পেয়েছিল কালি। বুঝতে পেরেছিল কী ঘটেছে। আটক করা হয়েছে তাকে। তখন থেকেই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগল ও। তার মনে হলো এটা ছাড়া স্টুয়ার্ডের আর কি-ই বা করণীয় ছিল? কালি আয়নার দিকে তাকাল আবার। দেখতে লাগল নিজেকে। তীক্ষ্ণ চোয়াল, নীল চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল ও। চার দেয়ালের মাঝে বন্দী রেখে ওকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে ওরা। চোখ বোলাল সে কেবিনটার ভেতরে। একটা সিঙ্গেল টুরিস্ট কেবিন এটা। যানটায় রয়েছে অসংখ্য কেবিন। সিঙ্গেল বেড, ডবল বেড এবং বেড ছাড়া বড় বড় কক্ষ। তবে বেশির ভাগই ট্যুরিস্ট কেবিন। কেবিনগুলো সুসজ্জিত। কেবিনের দেয়ালের উপরের অংশে রয়েছে আলো, তাপমাত্রা ও ভেন্টিলেশন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মিউজিক ও রোমাঞ্চকর ছবির টেপ, খাবার, ড্রিঙ্কস এবং অতিথির জন্যে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। একটা ফোনও রয়েছে এবং একটা বোতাম। স্টুয়ার্ডের রূমের সাথে দুটোরই সংযোগ রয়েছে। একটু ভেবে ফোনটা ব্যবহার করল সে, বোতামে চাপ দিল কিন্তু সাড়া পেল না ওপাশ থেকে। ঠিক এ সময়ে তার সামনের দেয়ালে লাল আলোর ঝলকানি হলো। দেয়ালের ভেতর দিয়ে ভেসে এল একটা কণ্ঠ।
আমরা ওভার ড্রাইভে যাচ্ছি। আমি ক্যাপ্টেন বলছি। বিশ মিনিট পরে আমরা ওভার ড্রাইভ দিতে যাচ্ছি। লাউঞ্জের যাত্রীরা তাদের নির্ধারিত কেবিনে ফিরে যান। সব যাত্রী তাদের কেবিনে অবস্থান করবেন। প্রথমেই সীটবেল্ট বেঁধে নেবেন। আমরা ওভার ড্রাইভে যাচ্ছি। আমি ক্যাপ্টেন বলছি....
সুইচ অফ করে দিল কাল্লি। এ ঘোষণার অর্থ হলো প্রত্যেক যাত্রীকে তার কেবিনে বাধ্যতামূলক ভাবে থাকতে হবে। এবং ক্রুরা থাকবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। কাল্লি যদি এখন বের হয় কেউ জানবে না। ঝুকি আছে কাজটাতে, কিন্তু কিছু করার নেই। ওভার ড্রাইভের আগেই তাকে সুযোগটা নিতে হবে।
নিজের চারপাশে তাকাল কাল্লি। কয়েদীরা জেল থেকে কিভাবে পালায় চিন্তা করল ও। খাড়া। অমসৃণ দেয়াল। ওটা বেয়ে উপরে ওঠা সম্ভব নয়। বিছানার তোশক উঠাল ও। তাকাল স্প্রিংয়ের দিকে। চাপ দিয়ে খাটটাকে উপরে তুলল, এত উপরে যে খাটের উপর দাঁড়ালে ছাদটাকে স্পর্শ করতে পারবে সে এবং বেরিয়ে আসতে পারবে ছাদের ভারী গোল ঢাকনা খুলে।
পকেটে হাত ঢোকাল কাল্লি। বের করে আনল একটা ভাজ করা কাগজ এবং সোনালি রংয়ের ফাউন্টেন পেন। কলমটার ক্যাপ ও নিব খুলে ফেলল সে। ভেতর থেকে একটা টিউব বের করে আনল। টিউবটাকে সরিয়ে রাখল একপাশে। তারপর পরনের প্যান্ট থেকে বেল্টটা খুলে ফেলল। বেল্ট থেকে মুক্ত করল বাকলটা। বাকলের এক বিশেষ স্থানে চাপ দিয়ে ফাউন্টেন পেনের টিউবটা আটকে দিল। কারিগরি বিদ্যা ফলানোর কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা পিস্তলের আকৃতি নিল। মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুলে আনল নকল মাঢ়ি। ওগুলো আসলে এক ধরনের বুলেট। বাকলের ফাঁকে ওগুলোকে ম্যাগাজিনের মত আটকে দিল সে। চোখ পড়ল পকেট থেকে বের করা কাগজটার দিকে। ভাজ খুলল ও। পড়ল ভেতরের লেখা।
নতুন পৃথিবী হবে আমাদের ঠিকানা, আমাদের ভালবাসা -লুসি
চমৎকার! ভাবল কাল্লি। নির্বোধ মেয়েদের কাছ থেকে এরকমই আশা করা যায়। চিরকুটে নতুন পৃথিবী সম্পর্কে ফুটে উঠেছে রোমান্টিক ধারণা। অথচ কাল্লি জানে সেখানে রোমান্টিকতা বলে কিছু নেই, নেই জীবনের চাঞ্চল্য। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সেখানে মরবে সবাই। কিন্তু মেয়েটা বিশ্বাস করেনি তার কথা। এই পৃথিবী থেকে কোটি কোটি মাইল দূরের নতুন পথিবী সম্পর্কে কথা বলার সময় মেয়েটার দুচোখে স্বপ্ন উপচে পড়তে দেখেছে সে।
ওটা একটা স্বর্গ, বিড়বিড় করে বলেছিল মেয়েটা। পুরানো পৃথিবীতে কে থাকবে বললো, কী আছে এখানে? মনে মনে তখন হেসেছিল কাল্লি। অনুভব করেছিল ওর পকেটে কি যেন গুজে দিচ্ছে মেয়েটা। এখন সেটাই দেখছে কাল্লি। কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। কি মনে করে আবার কুড়িয়ে আনল। পুরে রাখল পকেটে। বর্তমান সমস্যা নিয়ে ভাবল সে কেবিন থেকে তাকে বের হতে হবে। পাঁচ মিনিট এর মধ্যেই চলে গেছে। হাতে আছে মাত্র পনেরো মিনিট। দ্রুত উঠে দাড়াল সে বিছানার উপর। চাপ দিল ছাদের ঠিক মাঝখানে তার জন্যে এটা কঠিন কিছু না। এই নভোযানের সব কিছুই মুখস্থ তার। গত সপ্তায় এটার মডেল নিয়ে। খুঁটিনাটি দেখেছে সে। ঢাকনাটা সরে গেল। ঝুলে পড়ল সে। নিজেকে টেনে বের করে আনল। নেমে পড়ল করিডরে।
করিডরটা ফাঁকা। কেউ নেই। নীরব একেবারে। আশেপাশের সমস্ত দরজা বন্ধ।
হেঁটে এগুতে লাগল সে। নভোযানের ঠিক মাঝখানের জায়গায় এসে থামল। ইস্পাতের একটা মই দেখতে পেল সেখানে। উঠে গেছে মেঝে থেকে উপরের দিকে। কাল্লি দেখল উপরে মইয়ের মাথার দিকে ধাতুর তৈরি ভারী ঢাকনি বন্ধ করে রেখেছে উপরে উঠার পথ। কিছুক্ষণ চিন্তা করল ও। পিস্তলটা হাতের মধ্যে নিল। তারপর উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। একটা হাত উপরে উঠিয়ে মোচড় দিল সে ঢাকনির হাতলে। খুলে গেল ঢাকনি। পিস্তলটা হাতে নিয়ে উপরে উঠে এল। ভেতরে ঢুকেই থমকে গেল কাল্লি। বিছানার উপর বসে আছে আট বছরের কাছাকাছি ছোট্ট এক মেয়ে। তাকিয়ে আছে। সরাসরি ওর দিকে। পিস্তলের নলটা ঘোরাল কাল্লি। তাক করল মেয়েটার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর। আঙুল কিছুটা চেপে বসল ট্রিগারে। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা নড়ল না একচুলও মেয়েটাকে নিরুদ্বিগ্ন মনে হলো ওর। নিঃস্তব্ধতার ভেতর কাল্লি নিজের রক্ত চলাচলের শব্দ শুনতে পেল। টিপে দিল ট্রিগার। মৃদু দুলে উঠল বাচ্চা মেয়েটা। তারপর পড়ে গেল চিৎ হয়ে। দ্রুত তার কাছে চলে এল কাল্লি। ঝুঁকে কান পাতল বুকে। শুনতে পেল।
মেয়েটার নিঃশ্বাসের মৃদু আওয়াজ। উঠে দাড়াল কাল্লি। এ ধরনের গুলি রক্তে মেশে না। কিন্তু খুব দ্রুত নার্ভের উপর কাজ করে। এটা এনেসথেটিক গুলি। এর কল্যাণে মেয়েটা এখন। সুখনিদ্রা দেবে। এই রূমের ছাদেও একই রকম ঢাকনি রয়েছে। হাতলটা ধরে মোচড় দিতে যাবে, এমন সময় উপর থেকে ভেসে আসা নারী কণ্ঠ শুনতে পেল কাল্লি।
শয়তানটা ভেতরেই আছে, নারী কণ্ঠটা বলছে। ওকে আটকে রাখা হয়েছে।
সে কি করবে? বলল অন্য একটি নারী,
মাস আগে ঠিক এটার মত দেখতে। একটা নভোযান ছিনতাই করেছিল সে। সেটার নাম ছিল প্রিন্সেস অব অরগিল, কোন খোজ পাওয়া যায়নি তার। শুনেছি ওটার সবাইকে খুন করে সে, কেউ যাতে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে না পারে। শয়তানটা এই নভোযানে উঠেছে।
স্টুয়ার্ডটা তাকে চিনেই আটকে ফেলেছে।
আপনার ভয় করছে না?
আমি ভীত নই।
এই নভোযানেরও কেউ রেহাই পাবে না, যদি সে বেরোতে পারে।
কে বলল?
- ওহ, সবাই তা জানে।
কিছুক্ষণ ভাবল কাল্লি। পিস্তলটা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে আটকে নিল। তারপর মাথার উপরের ঢাকনির হাতলটা দুহাতে ধরে হ্যাচকা টান দিল। টানতে লাগল নিচের দিকে। ঢাকনি খুলে গেল। খোলা মুখের কিনারে দুহাত রাখল সে। তারপর লাফিয়ে মাথার উপরের কেবিনে উঠে এল। হাতে আবার চলে এল পিস্তলটা। রূমের ভেতর দুপাশে দুটো বিছানা। মাঝখানে ফাঁকা জায়গা। একটা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছে প্রায় বিশ বছরের এক মেয়ে। বেঁটে, হৃষ্টপুষ্ট শরীর। মাথায় সোনালি চুল। হাঁটুর উপর আড়াআড়ি ভাবে তোয়ালে বিছিয়ে নখে নেইলপলিশ মাখছে সে। অন্য বিছানার মেয়েটা লম্বা। মাথায় ঘন কালো চুল। দারুণ সুন্দরী।. ঝুঁকে পাশের ডেস্কে লিখছে কী যেন, সম্ভবত চিঠি। দুজনেই এক সাথে কাল্লির দিকে ফিরে তাকাল। চোখ গেল হাতের অস্ত্রটার দিকে। তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সোনালি চুলের মেয়েটি। মুখ ঢাকল তোয়ালে দিয়ে এবং সেই সাথে ঢলে পড়ল বিছানায়। কালোচুলের সুন্দরী মেয়েটার মুখমণ্ডল ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে
এল।
জিম! বলল সে সবিস্ময়ে।
দুঃখিত, বলল কাল্লি। আমার আসল নাম কাল্লি হোয়েন। ভুল নামে চিনতে আমাকে। এ ব্যাপারে আমি খুবই দুঃখিত, লুসি। এছাড়া উপায় ছিল না।
তুমি-তুমি তাহলে...
হ্যা, লুসি। আমিই সেই ছিনতাইকারী।
এখন আর দুর্ঘটনা এড়ানোর কোন পথ নেই।
আচ্ছা! বলল লুসি। তাকাল কাল্লির হাতে ধরা অস্ত্রের দিকে। তুমি কি আমাকে গুলি করতে চাও?
করতেও পারি, বলল কাল্লি। আমি ভাবতেও পারিনি পৃথিবী ছাড়ার জন্যে তুমি এতটা উতলা ছিলে।
তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, কাল্লি। ভাবলেশহীনভাবে বলল লুসি। কিন্তু তুমি--তুমি একটা খুনী। তোমাকে দেখে একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বনের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে খামার বাড়ির এক তরুণীর কাছে এসেছিল এক যুবক। ছেলেটাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেল মেয়েটা। ভেবেছিল, ছেলেটা সৈনিক হবেকিন্তু শেষকালে মেয়েটাকে সে। বলল সে একজন আউট-ল, বনের মধ্যে পালিয়ে আছে। ওহ কাল্লি....তুমিও...
অপমানে সংকুচিত হলো কাল্লি। লুসি-লুসি...
ওহ, ঠিক আছে, লুসি বলল। তাকাল কাল্লির দিকে। তোমার কাছে অস্ত্র আছে। কি করতে চাও আমাদের নিয়ে?
শুধু চুপচাপ বসে থাকো, বলল কাল্লি। এখান দিয়ে উপরে উঠব আমি।
দেয়ালের ফোনটার কাছে গেল সে। টেনে নামিয়ে আনল। রিসিভারটা। তুমি স্টুয়ার্ডকে ফোন করো। ফোনে ব্যস্ত রাখো ওকে। আমি যাবার পরেও কথা বলতে থাকো। খবরদার উল্টোপাল্টা কিছু কোরো না। এমন ভাব দেখাও যেন সব ঠিক আছে।
রূমের ভেতরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল কাল্লি। নিচে তাকিয়ে দেখল ওর দিকেই বিস্ময়ভরা চোখে চেয়ে আছে লুসি। উপরের রূমটায় ঢুকে দেখতে পেল রূমটা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। দরজা খুলে পাশের রূমটায় গেল সে। এই রূমটার ওপাশে আর কিছুই নেই। কেবল শূন্যতা। কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে সে চোখ রাখল বাইরে। বিশাল সব নক্ষত্র তীরের বেগে। যেন ছুটে যাচ্ছে নভোযানটার গা ঘেঁষে। মনে পড়ল লুসির কথা। বেচারি ভালবেসেছিল ওকে। সময় বেশি নেই। দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল কাল্লি। বাইরের করিডরটা তাকিয়ে দেখল এক নজর। হ্যা, উপরেরটা কনট্রোল রুম হবে, ভাবল সে। এগোল সামনে। কম্যুনিকেশন রূমের কাছে গিয়ে থামল। মনে হলো লুসির কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে সে, ভেতর থেকে। বিপরীত দিকের রূমটা খুলল ও। দেখতে পেল অত্যাধুনিক লেজার রাইফেলগুলো। একহাতে পিস্তলটা ধরে অন্যহাতে একটা রাইফেল তুলে নিল সে। তারপর করিডরে ফিরে এসে কান পাতল কমুনিকেশন রূমে। না, আর কেউ নেই, লুসি বলছে কাউকে, সে একাই।
হাতল ঘুরিয়ে দরজা নিঃশব্দে ফাক করল কাল্লি। লুসিকে দেখতে পেল। আরও আটজন রয়েছে রূমে। ওই লম্বামুখো স্টুয়ার্ডটাও রয়েছে, যে ওকে আটকে রেখেছিল কেবিনে।
হ্যা, আর কেউ নেই, গম গম কণ্ঠে বলল, কাল্লি।
সবাই বিদ্যুৎবেগে ঘুরল ওর দিকে। ভেতরে ঢুকে দরজার কাছের টেবিলের উপর পিস্তলটা রাখল কাল্লি। দুহাতে ধরল এবার। ভারী রাইফেলটা। সবাইকে কাভার দিচ্ছে সে।
আমি একা। একদম একা, বলে উঠল।
কী চাও তুমি? ক্যাপ্টেনের পোশাক পরা লোকটা জানতে চাইল। বলল। চেহারায় রাগ। প্রশ্নটাকে উপেক্ষা করল কাল্লি। রূমের ডান দিকে ঘুরে গেল সে। তোমাদের একজনকে এখানে দেখছি না, কাল্লি বলল, কোথায় সে?
ডিউটি নেই ওর, উত্তর দিল কাল্লিকে নিচের কেবিনে আটকে রাখা লম্বামুখো স্টুয়ার্ডটা, ঘুমোচ্ছে।
পেছনে ঘোরো,তাকে নির্দেশ দিল কাল্লি। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। রূমের প্রত্যেককে খুঁটিয়ে দেখল সে। কিসের যেন সতর্ক সংকেত দেখতে পেল লুসির চোখে। বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে লুসি।
তুমি এখানে ঢুকলে কেন? রুঢ় কণ্ঠে তাকে বলল কাল্লি। সাদা হয়ে গেল লুসির ঠোট দুটো। আমি নিচে তাকাই। দেখতে পাই কেবিনের বাচ্চা মেয়েটার কী হাল তুমি করেছ, ভেঙে এল লুসির কণ্ঠ। ফিসফিস করে বলল, ওহ, কাল্লি--
থামো! গর্জে উঠল কাল্লি। সবাই ওই কোনায় জড়ো হও। যতক্ষণ না কেউ বলছে অন্য লোকটা কোথায়, ততক্ষণ প্রতিবার একজনকে গুলি করব আমি। রেডি...
তুমি একটা বোকা, ক্যাপ্টেন বলল। প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তার মুখের রং। এখানে একা তুমি। নিজ থেকে, একা কিছুতেই এই নভোযানের নিয়ন্ত্রণ নেবার সুযোগ পাবে না। তুমি জানো নভোযান ছিনতাইকারীদের কপালে কী ঘটে? আত্মসমর্পণ করো, কাল্লি। আমরা তোমাকে নতুন পৃথিবীতে ছেড়ে দেব। মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে তুমি বেঁচে থাকতে পারবে।
ধন্যবাদ, বলল কাল্লি। আমরা ওভার ড্রইভ দেব ঠিকই, কিন্তু নতুন পথিবীর দিকে আমরা যাব না। কোর্স ঠিক করো, আমি যেভাবে বলব।
না! কঠোর শোনাল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ। তুমি বেশ সাহসী মানুষ। হাসল কাল্লি।
কিন্তু সহযোগিতা না করলে আমি তোমাকে গুলি করব। তারপর লাইন ধরে এক এক করে গুলি করতে থাকব তোমার অফিসারদের। নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইবে কেউ না কেউ। তোমাকে যা করতে বলেছি সেটা সে করে দেবে। ক্যাপ্টেনের চোখে চোখ রাখল কাল্লি। কী ঠিক করলে?
ঠিক আছে, কনট্রোল রূমে চলো। কোথায় নভোযান থামাতে হবে বলো আমাকে, ধীরে, সতর্কভাবে উত্তর দিল ক্যাপ্টেন। প্রথমে আমি প্রিন্সেস অব অরগিলের কাছে যেতে চাই। আমি দেখতে চাই ওটার ক্যাপ্টেন আর অফিসাররা কেউ বেঁচে আছে কিনা, বলল কাল্লি।
তাতে শুধু সময়ই নষ্ট হবে, বলল ক্যাপ্টেন। প্রিন্সেস অব অরগিল মহাশুন্যের কোন গলিতে পড়ে আছে কে জানে?
তুমি সহযোগিতা করছ না, ক্যাপ্টেন, কাল্লি লেজার রাইফেল তাক করল মেইন কম্পিউটার প্যানেলের দিকে। এবার পস্তাও।
না, গুলি করো না, ফার্স্ট অফিসার লাফিয়ে পড়ল মেইন কম্পিউটার প্যানেল এবং কাল্লির মাঝখানে। তাহলে বিস্ফোরণ ঘটবে। মারা যাব সবাই। এই নভোযানে কয়েকশো যাত্রী আছে। তোমার কোর্স কী? তুমি কোথায় আমাকে সেট করতে বলো? এখনি করে দিচ্ছি আমি।
কাল্লি হাসল। বুদ্ধিমান লোক। ফার্স্ট অফিসারকে অভিশাপ দিতে শুরু করল ক্যাপ্টেন। এমন জঘন্য ভাষায় গালি দিতে লাগল যে ভুলে গেল রূমটার মধ্যে লুসি আছে। ফাস্ট অফিসার কোর্স সেট করতে লাগল। কাল্লির নির্দেশ মত। মাত্র একবার স্টার্ট বন্ধ করল। আচমকা লাইট চলে গেল। এবং মহাকাশযান ওভার ড্রাইভ দিল। মাত্র এক সেকেন্ড পরেই আলো চলে এল। ঠিক সেই সময়ে বিস্ফোরণের মত শব্দ করে বেজে উঠল।
এলার্ম।
সুইচে চাপ দাও, বলল কাল্লি। ফার্স্ট অফিসার চলে এল সামনে। কমুনিকেশন রূমটার স্ক্রিনের সাথে সংযুক্ত বাটনে চাপ দিল। সাদা জ্যাকেট পরা এক লোককে হঠাৎ দেখা গেল পুরো স্ক্রিন জুড়ে। হাসি ফুটে উঠল কাল্লির ঠোটে। বিড় বিড় করে বলল, প্রিন্সেস অব অরগিল। স্ক্রিনের লোকটা তাকাল কাল্লির দিকে। মাঝারি বয়সের শান্ত সৌম্য চেহারা। বুড়ো আঙুল উঁচু করল সে।
ভেড়াও, বলল কাল্লি।
তুমি দুর্ঘটনা ঘটাতে চাও, কাল্লি? জিজ্ঞেস করল ফাস্ট অফিসার। এখানে সেটা সম্ভব না।
এই মুহুর্তে-- শুরু করল কাল্লি, কিন্তু শেষ করতে পারল না কথা। তার পেছন থেকে অন্য একটি কণ্ঠ ভেসে এল। তোমার খেল খতম।
কাল্লি ঘুরল না। চোখে মুখে দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে এই প্রথম নভোযানের অফিসারদের দিকে এবং লুসির দিকে দীর্ঘসময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল সে। তারপর দাত বের করে হাসল। হঠাৎ করেই হাসি মিলিয়ে গেল তার। বন্ধু, পেছনের লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। এটা রক্ষা করতে পারলে পৃথিবীর মানুষের চোখে তুমি হিরো হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুঃখের কথা হলো সে সুযোগ তোমার কখনোই হবে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল কাল্লি। ভাবল স্টুয়ার্ড অথবা অফিসাররা কেউ কিছু বলবে। কিন্তু মন্তব্য করল না কেউ। সবাই নিশ্চুপ।
তুমি আমার পেছনে আছ ঠিকই, বলল কাল্লি, কিন্তু ভবিষ্যৎ আমার অনুকূলে। আমাকে থামাতে পারবে না তুমি। যদি মনে করো আমি কেবল কথার কথা বলছি, আবার চিন্তা করো তাহলে।
ঘুরল সে। পা বাড়াল সামনে। তার কানের পাশ দিয়ে প্রথম বুলেটটা ছুটে গেল। পরের বুলেটটা তার সামনে মেঝেতে পড়ে লাফিয়ে উঠল। কাল্লিকে লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি করছে লোকটা। কিন্তু লাগাতে পারছে না। সম্ভবত লোকটা নার্ভাস হয়ে পড়েছে। কাল্লি ধীরে-সুস্থে তুলল রাইফেলটা। লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগারে চাপ দিল। লেজার আঘাত করল লোকটাকে। পড়ে গেল কুণ্ডলী পাকিয়ে করিডরের বাইরে। একই সময়ে পায়ে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল কাল্লি। গোটা রূম দুলতে শুরু করল তাকে ঘিরে। যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছে তার মুখ। রূমের সবাই বুঝল পায়ে গুলি খেয়েছে কাল্লি।
আহ! গুঙিয়ে উঠল কাল্লি। জোর করে হাসি টেনে আনল মুখে। বসে পড়ল। দেখল লুসি দরজার পাশের টেবিলটায় হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় তুলে নিল কাল্লির পিস্তলটা, যেটা কাল্লি আগে ওখানে রেখে দিয়েছিল।
না, লুসি! না, চিৎকার দিল কাল্লি কিন্তু লুসি দুহাতে পিস্তলটা ধরল। সোজা করে তাক করল কাল্লির দিকে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পড়ছে অশ্রু।
লুসি, তুমি কি আমাকে গুলি করতে চাও?
সেটাই তোমার জন্যে ভাল, কাল্লি! ফুঁপিয়ে উঠল লুসি। আমার সামনে একজনকে খুন করেছ তুমি। আরও খুন করবে। দুঃখিত, কাল্লি, তোমাকে গুলি না করে উপায় নেই আমার।
না, লুসি না! কথা শেষ হলো না কাল্লির। লুসির হাতে ধরা পিস্তলটা ঝাকি খেলো। প্রচণ্ড শব্দে বুলেট এসে আঘাত করল কাল্লির বুকে। জ্ঞান হারাল কাল্লি। যখন জ্ঞান ফিরে এল কাল্লির, সবকিছু প্রথমে ঝাপসা লাগল তার কাছে। পাশে দাঁড়ানো দেখল লুসিকে। সাদা জ্যাকেট পরা লোকটা কাল্লির মাথার কাছে। কেমন বোধ করছ? কাল্লিকে জিজ্ঞেস করল সাদা জ্যাকেট।
ভাল, অস্ফুট স্বরে বলল কাল্লি। কিন্তু এত দেরি করছিলে কেন?
আমি বুঝতে পারিনি তুমি আক্রান্ত হবে। সব এখন নিয়ন্ত্রণে। নিশ্চিন্ত থাকো। দুটো গুলি ঢুকেছিল, বের করে ফেলেছি, হাসল লোকটা।
লুসির কোন দোষ ছিল না, ডাক্তার, বিড়বিড় করে বলল কাল্লি। ও বুঝতে পারেনি।
ওহ। কী বোঝাতে চাইছে সে? কাঁদছে লুসি।
সে বোঝাতে চাইছে, কর্কশ স্বরে বলল সাদা জ্যাকেট পরিহিত ডাক্তার, তোমরা যারা নতুন পৃথিবীর জন্যে পাগল হয়ে উঠেছ সেই নতুন পৃথিবী বলতে কিছু নেই। পুরান পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে যে বিবৃতি দেয়া হচ্ছে তাও গুজব।
ওহ্। আপনিও তাই বলছেন? জ্বলে উঠল লুসির চোখ জোড়া।
ইয়াং লেডি, বলল ডাক্তার, আমাদের বন্ধু কাল্লি সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?
লুসির নাক টানার শব্দ শুনতে পেল কাল্লি। বলল, সে-সে একজন ছিনতাইকারী। প্রিন্সেস অব অরগিলকে ছিনতাই করেছিল সে। মেরে ফেলেছিল তার যাত্রীদের। আর এখন এই স্টার অব দ্য নর্থকেও সে ছিনতাই করেছে। আপনি সহযোগিতা করেছেন তাকে।
কেবল এ দুটোই নয়, এ পর্যন্ত আটটা নভোযান সে ছিনতাই করেছে, মৃদু হেসে বলল ডাক্তার। তাকে ওই দায়িত্বই দেয়া হয়েছিল। আসলে সে ছিনতাই করেনি, বরং রক্ষা করেছে। বোকা মানুষেরা পুরান পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ওদের ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে কাল্লি। এর জন্যে তাকে মাসে মাসে বেতনও দেয়া হয়।
কী বলছেন আপনি? কেঁপে গেল লুসির গলা। এমন জঘন্য কাজ তাকে বেতন দিয়ে করানো হচ্ছে?
ঠিক তাই, বলল ডাক্তার। কিন্তু এটাকে জঘন্য বলছ কেন? মানুষ তাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গুজব রটাচ্ছে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে পৃথিবী। প্রতিমাসে হাজার হাজার মানুষ চলে যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে। অবশ্য কাল্লি ফিরিয়েছে সবাইকে। তাদের দুর্ভাগ্য যে, শেষ পর্যন্ত নিজেদের বোকামিতে মারা পড়েছে
সবাই। কোথাকার কোন এক গ্রহকে নতুন পৃথিবী বললেই হলো? পুরান পৃথিবী ছাড়ার দরকারটা কি? পুরান পৃথিবীই বা এটাকে বলা হচ্ছে কেন? পৃথিবী তো পৃথিবীই। সবুজে শ্যামলে কত সুন্দর।
না, বলল লুসি। পৃথিবীটা এখন আর সুন্দর নেই। আমি জানি বিজ্ঞান একাডেমির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে নতুন পৃথিবীতে যাবার। পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু সব কারণ জানি না আমি। শুধু এটুকু জানি নতুন পৃথিবীতে আমাদের যেতে হবে। বিজ্ঞান একাডেমি সব কিছু ব্যাখ্যা করেনি।
আমার মনে হয়, বলল ডাক্তার, পুরোটাই ভুল বুঝেছ তুমি। ভুল বুঝেছে তোমার মত অনেকেই। বসবাসের অযোগ্য হয়নি পৃথিবী। বিজ্ঞান একাডেমির কিছু খামখেয়ালী লোক অন্যগ্রহ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চাইছে। এর বেশি কিছু না। তুমি কাল্লির সাথেই পৃথিবীতে ফিরে যাও। আমার মনে হয় তুমি আগের মতই তাকে পছন্দ করবে। পৃথিবীর মত অমন চমৎকার জায়গা আর কোথাও নেই,
হ্যা, পৃথিবীকে আমরা নুতন করে সাজাব, বলল কাল্লি। একেবারে নতুন করে। আমি জানি পৃথিবীকে ঘিরে একটা চক্রান্ত চলছে। কিন্তু ওরা তা পারবে না। আমরা ওটাকে আমাদের মত করেই গড়ে তুলব।
ওহ্ কাল্লি, কী ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে, লুসি বলল।
----------------------------------------------------------
নভোযান যেদিন পৃথিবীতে পৌছাল অবাক হয়ে গেল লুসি। হাজার হাজার মানুষ ফুলের তোড়া নিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে ওদের। মুখে হাসি। উৎফুল্ল লাফাচ্ছে সবাই।
স্বাগতম। কাল্লি, বলছে ওরা চিৎকার করে। আমাদের নিরাপত্তা তুমি নিশ্চিত করেছ। পৃথিবীতে এখন আর কোন শত্রু নেইনতুন পৃথিবীর কথা মুখে আনবার মতও নেই কেউ। ধন্যবাদ কালি। এমন সুখের জীবন আমাদের আর কখনোই ছিল না। হঠাৎ লুসির দিকে চোখ পড়ল ওদের। নিমেষেই থমকে গেল ওরা। চোখে মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। ও-ও বেঁচে আছে কীভাবে?
হাসল কাল্লি। কেন? ওকি তোমাদের অনেকের চেয়ে দেখতে সুন্দর নয়?
কিন্তু কিন্তু ও একজন মানুষ...
বাচ্চা তৈরির ক্ষেত্রে মানুষের কোন তুলনা নেই, বলল কাল্লি। ডাক্তারও একই কথা বলবে। নভোযানের মধ্যেই ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিল। ওর পেটে এখন বড় হতে থাকবে আমার সন্তান। প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তো কিছু করা যাচ্ছে না, তাই নয় কি?
বিমূঢ় দৃষ্টিতে কাল্লির দিকে তাকাল লুসি। ঢোক গিলল। কাল্লি তোমার কথা বুঝতে পারছি আমি। এরাও বা কী বলছে? কাল্লি আমাকে ঠিক করে বলল, কী হচ্ছে এসব?
দুঃখিত, ডার্লিং, উত্তর দিল কাল্লি।
বিজ্ঞান একাডেমির আশংকাই সত্যি হয়েছে। পৃথিবী আসলেই মানুষের জন্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। এর কারণ হলো আমরাই এটাকে দখল করে নিচ্ছিলাম। বিজ্ঞানীরা টের পেয়ে গিয়েছিল সেটা। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তখন। শেষ পর্যন্ত তারা নতুন পৃথিবী নাম দিয়ে অন্য এক গ্রহে পাঠাতে চাচ্ছিল এই পৃথিবীর মানুষদের, যাতে সেখানে টিকে থাকে তারা। কিন্তু সফল যে হয়নি তা তো দেখতেই পাচ্ছ। একটা নভোযানও যেতে পারেনি সেখানে। মহাকাশে আমরাই ওগুলো ছিনতাই করেছি। বেশিরভাগক্ষেত্রে
আমি। আমি নাহলে অন্য কেউ। সব মানুষকে মরতে হয়েছে। তুমিই একমাত্র মানুষ যে এখনও বেঁচে আছ।
তোমরা-তোমরা কারা? ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল লুসি। এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না তার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে সে। স্বপ্ন ভেঙে গেলেই দেখবে সব ঠিকঠাক আগের মতই আছে। কিন্তু সে জানে এটা স্বপ্ন নয়। সত্যিই বেদখল হয়ে গেছে পৃথিবী। চোখ মেলে দূরে তাকাল লুসি। সব কেমন প্রাণহীন, ফাঁকা।
আমরা জন্মেছিলাম এসটেরোপ ফোর গ্রহে, বলল কাল্লি। জায়গাটা পৃথিবীর মত এত সুন্দর না। তাই পৃথিবীতেই চলে এসেছি আমরা। এটাই এখন আমাদের ঠিকানা। তোমাদের মতই বুদ্ধিমান আমরা কখনও কখনও আরও বেশি। এবং শক্তিশালী। প্রমাণ তো পেয়েছই।
আমাকে...আমাকে কি তোমরা মেরে ফেলবে?
হ্যা লুসি, কালি বলল। অবশ্য মানুষের একটা নমুনা হিসাবে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। তাছাড়া তোমার পেটে আমার বাচ্চা আসছে। যা হোক, তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা পরে নেব। বাচ্চাটা আগে জন্ম নিক। দেখি। মানুষের পেটে আমাদের বাচ্চারা কেমন হয়ে জন্মায়।
হঠাৎ গা গুলিয়ে উঠল লুসির। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। বুঝতে পারল, নভোযানে সবাইকে মেরে ফেললেও ওকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছিল তখন। পাশে তাকাল লুসি। খাদের ভেতর লাফ দিয়ে পড়লে সেকি মরবে না? মনে মনে প্রস্তুতি নিল লুসি।
দুঃখিত, বলল কাল্লি। আত্মহত্যার কথা চিন্তাও করো না। অন্তত বাচ্চাটা জন্ম নেবার আগ পর্যন্ত। চলো, নামা যাক। মুশকিল হয়েছে কি জানো? মানুষের চিন্তাভাবনা সব আমরা আগে থেকেই পড়ে ফেলতে পারি। নাও, ডান পা-টা আগে বাড়াও....
নেমে এল ওরা। ধীরে ধীরে পেছনে বন্ধ হয়ে গেল নভোযানটির দরজা। উল্লসিত জনতা ফুল ছিটিয়ে বরণ করল ওদের।
 




(বিদেশী গল্প থেকে অনুবাদকৃত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন