সায়েন্স ফিকশন,প্রথম সূত্র, আইজ্যাক আজিমভ,Science Fiction,First Law,Isaac Asimov |
রোবট শাস্ত্রের তিনটি সূত্রঃ
১. রোবট কখনও কোনো মানুষকে আঘাত করতে পারবে না অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে কোনো মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না।
২. রোবট সর্বদা মানুষের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে,
যদি না সেই আদেশ প্রথম সূত্রের পরিপন্থী হয়।
৩. রোবট সর্বদা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করবে,
যদি না সেই আত্মরক্ষার চেষ্টা প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রের পরিপন্থী হয়।
মাইক ডোনোভ্যান হাতের খালি বিয়ার-মগটার দিকে তাকালো, মুখে একঘেয়েমি আর বিরক্তির ছাপ। ভাবলো, নাঃ অনেক শোনা হয়েছে। অতএব উঁচু গলায় বললো, ‘অদ্ভুত রোবট নিয়েই যদি কথা হয় তাহলে
আমি একটা কথা জানি যেটা প্রথম সূত্র মানেনি।’
যেহেতু ব্যাপারটা পুরোপুরি অসম্ভব তাই প্রত্যেকেই থামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ডোনোভ্যানকে দেখলো।
লম্বা-চওড়া কথা বলার জন্য ডোনোভ্যান সঙ্গে সঙ্গেই প্রমাদ গুনলো। তাড়াতাড়ি বিষয় পালটে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় বললো,
‘গতকালই একটা জব্বর গপ্পো শুনলাম যে--’
ডোনোভ্যানের পাশের চেয়ারেই ছিলো ম্যাকফারলেন। সে বললো, তার মানে তুমি একটা রোবট দেখছো যেটা কোনো মানুষকে মেরেছে বা বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে?’ সন্দেহ নেই,
প্রথম সূত্রে অবাধ্য হওয়ার অর্থই হলো এই।
ডোনোভ্যান বললো, ‘অনেকটা সেই রকমই। তবে আমি বলছিলাম, কাল একটা--’
‘ব্যাপারটা খুলে বলো দেখি’– ম্যাকফারলেন যেন আদেশ করলো। অন্যান্যদের কেউ কেউ টেবিলে বিয়ার-মগ ঠুকে শব্দ করলো।
ডোনোভ্যান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করলো। চটপট ভেবে-টেবে নিয়ে বললো,
‘ঘটনাটা ঘটেছিলো টাইটান-এ,
দশ বছর আগে। হ্যা,
পঁচিশ সালেরই ঘটনা। তিনটে নতুন মডেলের রোবট তখন সদ্য আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। রোবটগুলো বিশেষভাবে টাইটান-এর জন্যেই তৈরি। এম.
এ. মডেলের প্রথম দিককার মাল। আমরা ওদের নাম দিয়েছিলাম এম্মা ওয়ান, টু আর থ্রী।’ আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে আর একটা বিয়ার দিতে ইশারা করলো ডোনোভ্যান, তারপর একদৃষ্টে ওয়েটারের যাওয়া দেখতে লাগলো। দেখা যাক, এরপর কি হয়।
ম্যাকফারলেন বললো, “মাইক,
আমার জীবনের অর্ধেকটা ভাই রোবট শাস্ত্র নিয়েই কেটে গেলো। কিন্তু এম. এ.
মডেলের নাম তো কখনও শুনিনি?'
‘শোনোনি তার কারণ এম. এ.
মডেলটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। মানে,
যে ঘটনার কথা তোমাদের শোনাতে বসেছি তার পরে-পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। তোমার মনে নেই?’
‘না তো।’
ডোনোভ্যান তাড়াতাড়ি আবার বলতে শুরু করলো, ‘রোবটগুলো আসামাত্রই আমরা কাজে লাগিয়ে দিলাম। কারণ বুঝতেই পারছো, ঝড়ের মওসুমে আমাদের বেস একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে বসেছিলো। আর টাইটানে ঝড়ের মওসুম বলতে বছরের শতকরা আশি ভাগ। বছর মানে শনি গ্রহকে এক পাক ঘুরে আসতে টাইটানের যা সময় লাগে। সাংঘাতিক তুষার-ঝড়ের সময় একশো গজ দূর থেকেও বেস খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব ছিলো। আর কম্পাস সেখানে কোনো কাজে আসে না, কারণ টাইটানের কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই। এই এম. এ. রোবটগুলোর গুণ হলো ওগুলোতে এক নতুন ধরনের ভাইব্রো-ডিটেক্টর লাগানো ছিলো। ফলে যে কোনো অবস্থার মধ্যেও ওরা সরাসরি বেস-এ ফিরে আসতে পারতো। আর তার মানেই খনিজের সন্ধান করার কাজটা চব্বিশ ঘণ্টা চালাতে কোনো অসুবিধে ছিলো না। না, কিছু বলার দরকার নেই, ম্যাক। ভাইব্রো-ডিটেক্টরগুলোও মার্কেট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিলো, যার জন্যে তুমি ওগুলোর কথা শোনোনি। ডোনোভ্যান কাশলো, ‘মিলিটারি সিক্রেট, বুঝতেই পারছো।’ সে বলে চললো,
‘প্রথম ঝড়ের মওসুমে রোবটগুলো ভালোই কাজ করলো। কিন্তু ঝড়ের শেষে শান্ত আবহাওয়া শুরু হতেই এম্মা টু গোলমাল শুরু করলো। ঘুরঘুর করে আনাচে-কানাচে ঢুকে পড়তে লাগলো। ঐসব অস্থান-কুস্থান থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে বের করে আনতে হতো। শেষে একদিন ও বেস ছেড়েই কেটে পড়লো, আর ফিরে এলো না। আমরা ভাবলাম তৈরির সময় রোবটটার মধ্যে কোনো গলদ থেকে গিয়েছিলো। অতএব বাকি দুটোকে নিয়েই কাজ চালাতে লাগলাম। কিন্তু কাজের হাতে টান পড়া-
মানে, কাজের রোবটে টান পড়ায়- শান্ত মওসুমের শেষে আমাদের একজনের কর্নস্ক-এ যাবার দরকার পড়লো। রোবট ছাড়া রওনা হবার ঝুঁকি নিতে আমি নিজে থেকেই রাজি হলাম। এমনিতে ভয়ের কিছু ছিলো না,
অন্তত দুদিনের ভেতরে ঝড়ের মওসুম শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তাছাড়া বড় জোর বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আমার ফিরে আসার কথা। বাতাস ভারি হয়ে ঝড় যখন শুরু হলো তখন আমি ফেরার পথ ধরেছি- তবে বেস্ থেকে তখনও পাক্কা দশ মাইল দূরে। এয়ার কারটা ঝড়ের দাপটে চুরমার হওয়ার আগেই ওটা মাটিতে নামালাম। তারপর বেস্ লক্ষ্য করে দৌড় শুরু করলাম। মাধ্যাকর্ষণ কম থাকায় দূরত্বটা দৌড়ে পার করা তেমন কিছু কঠিন ছিলো না, তবে সরলরেখায় দৌড়ানো কি সম্ভব হবে? সেটাই হলো আসল প্রশ্ন। সঙ্গে বাতাস অনেকটা ছিলো আর স্যুটের হীট কয়েলগুলোও মোটামুটি ঠিকঠাক ছিলো, কিন্তু টাইটানের ঝড়ে দশ মাইলও অকূল পাথার।
দেখতে দেখতে তুষার-বৃষ্টি সব আঁধার করে দিলো। যেন নেমে এলো কালচে গোধূলি। এমন কি শনি গ্রহও আবছা হয়ে শেষে ঢাকা পড়ে গেলো। আর সূর্য তো একটা ফ্যাকাশে পুটলি। হঠাৎই আমি থমকে দাঁড়ালাম। ঝোড়ো হাওয়ার মোকাবিলায় হেলে দাঁড়ালাম ঝড়ের মুখোমুখি। আমার ঠিক সামনেই কালো মতো ছোট্ট কি একটা জিনিস চোখে পড়লো। ভালো করে তার চেহারাটা দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলাম বস্তুটা কি। একটা ঝোড়ো-কুকুর। এই একমাত্র প্রাণী যা টাইটানের দুরন্ত ঝড় সইতে পারে। আর একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর হিংস্র, এ-রকম সাংঘাতিক জীব আর কোথাও আছে বলে জানি না। স্পষ্ট বুঝলাম, ওটা কামড় বসালে স্পেস-স্যুট আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আর ঐ-রকম অল্প আলোয় নিশানা নিখুঁত না করে ফায়ার করাও মুশকিল। কারণ একবার মিস করলেই ওটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আস্তে আস্তে পেছোতে লাগলাম আর কালো ছায়াটাও আমাকে অনুসরণ করলো। ওটা খুব কাছে। এগিয়ে আসতেই ঈশ্বরের নাম করে আমি ব্লাস্টার উঁচিয়ে ধরলাম। আর ঠিক তক্ষুণি একটা বিশাল ছায়া হঠাৎ আমার একেবারে গায়ের ওপরে এসে পড়লো। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো। এম্মা টু আমাদের হারিয়ে যাওয়া এম.
এ. রোবট। রোবটটার কি হয়েছিলো সেসব নিয়ে একটুও মাথা না ঘামিয়ে আমি স্রেফ চিৎকার করে ওকে বললাম, এম্মা, ঝোড়ো-কুকুরটাকে পাকড়াও করো;
তারপর আমাকে বেস্-এ ফিরিয়ে নিয়ে চলো।
রোবটটা এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমার কথা সে শুনতেই পায়নি। চেঁচিয়ে বলে উঠলো একই সঙ্গে, ‘প্রভু, ফায়ার করবেন না। ফায়ার করবেন না।’
তারপর ঝোড়ো-কুকুরটাকে লক্ষ্য করে বেদম ছুট লাগালো। ‘হতচ্ছাড়া কুকুরটাকে শিগগির পাকড়াও করো, এম্মা। আমি চিৎকার করে বললাম।’
কুকুরটাকে এম্মা ধরলো ঠিকই। ওটাকে সোজা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ছুটে চললো একইভাবে। ওকে ডেকে ডেকে আমার গলা ভেঙে গেলো কিন্তু ও আর ফিরে এলো না। ঐ ঝড়ের মাঝে আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে রোবটটা চলে গেলো।’
নাটকীয়ভাবে থামলো ডোনোভ্যান। একটু পরেই বললো,
‘প্রথম সূত্রটা তো তোমরা নিশ্চয়ই জানো
? রোবট কখনও কোনো মানুষকে আঘাত করতে পারে না অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে কোনো মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না! তাহলেই বোঝো, এম্মা টু ঐ ঝোড়ো-কুকুরটাকে নিয়ে পালিয়ে গেলো আর আমাকে রেখে গেলো মরবার জন্যে। এতো প্রথম সূত্রকে স্রেফ অমান্য করা। যাই হোক, কপাল জোরে সেবার বেঁচে ফিরে এসেছিলাম। আধ ঘণ্টা বাদে ঝড় থেমে গেল। ঝোড়ো মওসুম শুরু হওয়ার আগের একদফা ঝড় ছিলো ওটা নেহাতই টেম্পোরারি ব্যাপার। কখনও কখনও ও রকমটা হতো। আমি তড়িঘড়ি রওনা হলাম বেস্-এর দিকে। আর ঝোড়ো-মওসুম সত্যিকারের শুরু হয়েছিলো পরদিন থেকে। আমি ফেরার ঘণ্টা দুই পরে এম্মা টু ফিরে এসেছিলো। রহস্যটা তখনই ফাঁস হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে মার্কেট থেকে এম.
এ. মডেলগুলো তুলে নেওয়া হলো।
‘তা সে রহস্যটা কি? ম্যাকফারলেন জানতে চাইলো।
ডোনোভ্যান গম্ভীর মুখে তাকে দেখলো, ‘ম্যাক, এ কথা ঠিক যে আমি একজন মানুষ এবং আমি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু ঐ রোবটটার কাছে অন্য কোনো জিনিস ছিলো আমার বিপদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি প্রথম সূত্রের চেয়েও জরুরি। ভুলে যেও না,
এই রোবটগুলো ছিলো এম. এ. সিরিজের, আর ঐ এম.
এ. রোবটটা লোপাট হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই আনাচে-কানাচে আড়াল খুঁজে বেড়াতো যেন কোনো একটা বিশেষ ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে নিজস্ব কোনো গোপন ঘটনা। আর শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে এ-রকম তাই ঘটেছে।’ শ্রদ্ধা-গদগদ চোখে ওপরের দিকে তাকালো ডোনোভ্যান। তার গলার স্বর কাঁপতে লাগলো ? ‘ঐ ঝোড়ো-কুকুরটা মোটেই ঝোড়ো-কুকুর ছিলো না। এম্মা টু যখন ওটা নিয়ে বেস্-এ ফিরে এলো তখন আমরা ওটার নাম দিয়েছিলাম এম্মা জুনিয়র। আমার বন্দুকের মুখ থেকে ওটাকে না বাঁচিয়ে এম্মার কোনো পথ ছিলো না। মাতৃস্নেহের (মাদারলি এফেকশন – এম. এ.) পবিত্র বন্ধনের কাছে প্রথম সুত্রের জোর আর কতোটুকু, বলো?’
মারুফ আল মাহমুদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন