সায়েন্স ফিকশন,প্রজন্ম,Science Fiction,Projonmo |
সায়েন্স ফিকশন - প্রজন্ম - রাসেল আহমেদ - Science Fiction - Projonmo - Rasel Ahmed
- - - - - - - - -
ছেলেমেয়েদের
মধ্যে যেরকম উৎসাহ মি. লিউন আশা করেছিলেন সেরকম তিনি দেখতে পেলেন না। ওদের দশ-বারো
বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মতো ওরা ওদের দাদার বাড়ি যাচ্ছে। দাদার বাড়ি দেখা এবং
জানার গুরুত্ব হয়তো এই শিশুদুটি উপলব্ধি করতে পারছে না, কিন্তু
একটা নতুন জায়গায় যাবার এবং নতুন নতুন জিনিষ দেখবার যে আনন্দ তাও কি এদের
স্পর্শে করছে না? মি. লিউনের সন্দেহ হলো, এই যান্ত্রিক যুগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোও এক একজন যন্ত্র-মানুষ হয়ে
বেড়ে উঠছে কি না! তিনি নিজে অবশ্য যাওয়া নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহের মধ্যে আছেন। অনেকদিক
ভেবে তাই আগামী সপ্তাহের চমৎকার একটি দিন ঠিক করেছেন রওনা দেবার। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত সপ্তায়। তিনি নিজে কর্মস্থান থেকে
অবসর বের করে নিয়েছেন বেশ কয়েকদিনের। তার স্ত্রীরও এসময়টায় কাজের চাপ কম। আবার
এর মধ্যে শুনলেন, ওই অঞ্চলে যাবার জন্য সরকার আকাশযানের বিশেষ
দুটি ফ্লাইট চালু করেছে। স্ত্রীকে মহা উত্তেজনায় বললেন, দেখেছ,
সবকিছু কেমন মিলে যাচ্ছে!
স্ত্রী
খুব একটা অনিচ্ছুক ছিল না কখনই, কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে উৎসাহ ফিরিয়ে
আনার লক্ষ্যে সবাইকে নিয়ে অনেক কিছু কেনাকাটাও করে ফেললেন। কিছু জিনিষ অপ্রয়োজনীয়।
কিছু আবার ভীষণ দরকারী। যেমন, গরম পোষাক। এসময়টায় ওখানে।
বেশ শীত পড়ে। তাদের এ অঞ্চলে তাপমাত্রার খুব একটা হেরফের হয় না বলে গরম পোষাক
দরকার হয় না। একারণে বাজারেও খুব একটা কিনতে পাওয়া যায় না। অনেক জায়গা ঘুরে
অবশেষে সবার জন্য জোড়া করে গরম পোষাক যোগাড় করতে পারলেন।
সন্তানদেরকে
জিজ্ঞেস করলেন, এ সুযোগে তারা বিশেষ কিছু কিনে নিতে চায় কি না।
বারো
বছরের বড় ছেলেটি অবাক করে দিয়ে বলল, ‘বাবা, আমাদের
কি সেখানে গ্যাস-মুখোশ নিয়ে যেতে হবে না?’
তিনি
ধৈর্য ধরে বিরক্তি এবং রাগ সামলালেন। আসলে এখানে বড় হওয়া এ যুগের ছেলেমেয়েদের
হাজার মাইল দূরবর্তী ওই জায়গাটা সম্বন্ধে রয়েছে একটা গভীর বিতৃষ্ণা এবং ভুল
ধারণা। বস্তুত এ সম্বন্ধে ওদের সমস্ত জ্ঞান আসে টেলিভিশন এবং হলো পত্রিকাগুলো
থেকে। এসব বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমগুলো ওই জায়গাটাকে এমনভাবে বর্ণনা করে যেন ওখানে
মানুষ থাকে না, থাকে ভিন্ন জেনেটিক গঠনের কিছু আশ্চর্যজনক প্রাণী! হতে
পারে ওই জায়গাটা সামান্য অনগ্রসর এবং অবৈজ্ঞানিক-কিন্তু তাই বলে এতটা! এখনকার
ভূমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ওরা এই কাজটা কর কিনা কে জানে!
তিনি
শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দেখ, ওখানে আমাদের মতো
মানুষেরাই থাকে তারা কেউ গ্যাস-মুখোশ ব্যবহার করে না। তারা যদি এতে বেঁচে থাকতে
পারে, তবে আশা করি আমরাও পারব!’
কোথাও
একটা ভুল করেছে বুঝতে পেরে ছেলেটি চুপ হয়ে গেল।
মি.
লিউনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি উপলব্ধি করলেন, ভুলটি আসলে তাঁর।
তাঁরই উচিত ছিল আরো আগেই ওদেরকে ওদের দাদার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাওয়া। এরপর
প্রতিবছর সম্ভব না হলেও দু’চার বছর পর পর
কাজটি করা। তিনি সেটা করতে
পারেন নি। আজ হঠাৎ যখন তিনি সেখানে যেতে চাচ্ছেন, তখন ওদের অনিচ্ছা
এবং অজ্ঞানতার জন্য তিনি ওদের সাথে রাগারাগি করতে পারেন না। তার উচিত সবকিছু
সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয়া যাতে ওরা বরং যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়।
সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী তিনি ছেলেমেয়েদেরকে অবসরে ওদের দাদার বাড়ি কথা নিজের আদি-বাড়িতে কাটানো
তার চমৎকার শৈশব দিনগুলোর কথা বললেন। তিনি বললেন এখনো তার কল্পনায় জ্বলজ্বলে হয়ে
ভাসা তাদের লাল-সাদা বাড়িটির কথা, বাড়ির পাশের শক্ত বাদামী
বাকলের বিশাল সবুজ গাছটির কথা এবং মাত্র আধ মাইল দূরের নদীটির বরফের মতো জমে
যাওয়া পানির কথা! কিন্তু কেন তিনি এসব বলছেন?
সেখানে
ওই বাড়িটি ছিল তার বাবার তৈরি করা। মি. লিউন তার শৈশব এবং কৈশোরের একটি
গুরুত্বপূর্ণ অংশ কাটান সেখানে। তার যখন বয়স ১০, তখন তার বাবা উন্নত
জীবনের আশায় ওই জায়গা ছেড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এইখানে এসে স্থায়ী
ভাবে বাস করা শুরু করেন। এরপর ওদিকে আর কখনো যাওয়া হয় নি। কয়েক বছর পর বাবা
মারা গেলে ওখানকার স্মৃতি মোটামুটি তার মাথা থেকে মুছে যায়, কারণ, তখন তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন এবং
নতুন ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এভাবে পার হয়ে গেছে পুরো বাহান্নটি
বছর! বাহান্ন বছর! সময় কি সত্যি এত দ্রুত যায়?
এরমধ্যে
বেশ কয়েকবার অবশ্য ভেবেছেন সেখানে যাবেন। কিন্তু কোনোবারই সবকিছু একসাথে হয়ে ওঠে
নি। ঘাটতি থেকে গেছে কোনোটার। কোনোবার অর্থ, কোনেবার সময়, কোনোবার ইচ্ছা!
কিন্তু
জীবনে একটি সময় আসে, যখন মনে হয় পার্থিব সাফল্যই সব আনন্দের শেষ কথা
নয়। আরো কোথাও কিছু একটা আছে, যা এই কৃত্রিম ভূমির সবকিছুর
অতিমাত্রায় বিশুদ্ধতার যান্ত্রিকতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না! শুধু তিনি নন,
তাঁর প্রজন্মের অনেকেই আজ এ বোধ দ্বারা তাড়িত! কিন্তু কারো যাবার
সামর্থ্য হয়, কারো হয় না! বাঁধা-ছাদার কাজটিও তিনি একসময়
স্ত্রীকে সাথে নিয়ে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে করে ফেললেন। নিতে হবে অনেক কিছু। কিছু
একটা ভুল করে ফেলে গেলে সমস্যা হবে। তাই হাতে
কয়েকদিন সময় থাকতেই তিনি কাজটি শেষ করে রাখলেন। যাতে পরবর্তীতে মনে পড়লে ভুলে
পাওয়া জিনিসটি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। নিজের আদিবাড়িটি যেহেতু এতদিনে
নিঃসন্দেহে ধ্বংস বা দখল হয়ে গেছে, সেহেতু থাকতে হবে ভাড়া করা
কোথাও- সে প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। এতদিনে সেখানকার অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে
গেছে, গিয়ে কিছুই বুঝে ওঠা যাবে না। সুতরাং সাবধান থাকা ভালো।
এতসব
বাক্স-পেটরার লটবহর এবং ক্লান্তিহীন কর্মযজ্ঞ একসময় ছেলেমেয়েরাও উপভোগ করতে শুরু
করল, এবং বাবার আনন্দ অচিরেই তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে গেল।
টানা
৪৭ ঘণ্টার ভ্রমণের পর তারা যখন গন্তব্য এসে নামলেন তখন সেখানে সকাল। আকাশযান
স্টেশনে বাইরে এসে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মি. লিউন চমকে গেলেন! চারিদিকে যা
দেখছেন,
সে ছবি সম্পূর্ণ অপরিচিত! যেন তিনি ভুল কোনো জায়গায় এস নেমে
পড়েছেন! মানুষজন, বাড়িঘর, যানবাহন সব
মিলিয়ে একটা অস্বস্থিকর ঘিঞ্জি অবস্থা! বাতাসে এত ধুলা যে তার ভেতরে দিয়ে
সবকিছুই দেখা যাচ্ছে ঘোলা! তিনি তীব্র সবুজ গাছের সারি খুঁজলেন, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো দু’চারটি
শীর্ণ ধূসর উদ্ভিদ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না! ছোট মেয়েটি জানতে চাইল, ‘বাবা, এই-ই
পৃথিবী? তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘হ্যা, মা,
এই-ই পৃথিবী!’
তার
ইচ্ছা ছিল বলার : দেখ এই গ্রহের সবই প্রাকৃতিক! তোমাদের গ্রহের মতো মানুষ এখানে
বলয়ের ওপর শহর তৈরি করে থাকে না, মানুষ থাকে মাটিতে; আকাশটি এখানে টাংস্টেন ধাতুর তৈরি নয়; গাছগুলো
একটাও সিনথেটিক নয়, সব জীবন্ত; এবং এই
যে বাতাস অনুভব করছ তা কারখানায় উৎপন্ন করা বাতাস নয়, সমুদ্র
থেকে উঠে আসা বাতাস! ... কিন্তু তিনি বলতে পারলেন না। তার মনে হলো প্রাকৃতিকতা
এখানে অনুপস্থিত এবং সমস্ত পৃথিবীটি তার শৈশবের বাড়িটির মতো পরিত্যক্ত! ছেলেটি
জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তোমাদের আদি-বাড়িটি
কোথায় ছিল?’
এত
বছর পর কোনো কিছুই আর চিনে ওঠা অসম্ভব। তিনি দু’দিকে তাঁর
হাত প্রসারিত করে দিলেন এবং এই প্রথম অবহেলিত এই গ্রহটির প্রতি তীব্র মায়া এবং
কৃতজ্ঞতা অনুভব করে কাপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘এইখানে। এই-ই আমার
আদি বাড়ি!’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন