বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টজেন,এক্স রে আবিষ্কারের গল্প,Wilhelm Conrad Röntgen,the discovery of X- Ray |
বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টজেন ও এক্স রে আবিষ্কারের গল্প - Wilhelm Conrad Röntgen and the discovery of X- Ray
এক্স-রের ব্যবহার আজ শুধু যে চিকিৎসা ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ তা শিল্প ক্ষেত্রে ও বিজ্ঞান-গবেষণা-এমন কি গোয়েন্দাগিরির কাজেও এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। তবে এক্স-রে আবিষ্কারের সাথে সাথে এর ব্যবহার যে উল্লেখযোগ্য বা মূল্যবান দিকটি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে—আশার সঞ্চার করেছিল-সেটি হলো, এই আবিষ্কার তাঁদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। নতুন কিছু, আবিষ্কারের পথ তাঁরা খুজে পেয়েছিলেন এই আবিষ্কারের সূত্রে। কেননা, এই আবিষ্কারটি এমন এক সময়ে ঘটে যখন পদার্থ বিজ্ঞানে তেমন বড় কিছু আবিষ্কারের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তোমরা হয়তো জানো যে, পরবর্তীকালে পরমাণুর অনেক ভিতরের খবর জানার সুযোগ ঘটে এই এক্স-রে আবিষ্কারের ফলে। আর এই জানাটা যে কতটা অগ্রগতি এনেছে আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বেশি নয়, আধুনিক যুগকে ‘অ্যাটোমিক এজ’ (Atomic Age) বা পারমাণবিক যুগ নামকরণটি থেকে। তাই এক্স-রে আবিষ্কার একাধারে একটি মহৎ ও যুগান্তকারী আবিষ্কার। কিন্তু মজার কথা কি জান? এই মহান বা বিরাট আবিষ্কারটি ঘটে একেবারে হঠাৎ করেই-অথাৎ আকস্মিকভাবে। আর যিনি এই আকস্মিক আবিষ্কারটি করেন তার নাম তোমরা হয়তো সকলেই জান। তিনি হলেন বিশিষ্ট জামনি বিজ্ঞানী-উইলহেম কোনরাড রন্টজেন (Wilhem Conrad Rontgen)। (কেউ কেউ আবার রন্টজেন নামটি রন্টগেন বা রঞ্জেন বলে উচ্চারণ করেন। আর সেই সুত্রে তাঁর অবিকৃত রশ্নিটিকে বলেন, রঞ্জন রশ্মি )।
রন্টজেন ছিলেন উর্টযবার্গ (Wurtzberg) বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ১৮৯৬ সালের ১ জানুয়ারী তিনি তাঁর এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। তবে জেনে রাখ, এক্স-রে আবিষ্কারের পরপরই তিনি কিন্তু সেটি প্রকাশ করেন নি। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি তিনি প্রকাশ করেন আবিষ্কারের দু’বছর পর।
এক্স-রে আবিষ্কারের ঘটনাটি ঘটে ১৮৯৫ সালের শেষাশেষি। এ সময়ে ক্যাথোড রশ্মি (cathode ray) নিয়ে জোর গবেষণা চলছিল। প্রায় বায়ু শূন্য এক বিশেষ ধরনের কাচের নলের (crookes tube) ভেতর দিয়ে যদি জোরালো বিদ্যুৎ প্রবাহ চালানো হয় তবে অদশ্য এক প্রকার রশ্মির আবির্ভাব ঘটে, যাকে বলা হয় ক্যাথোড রশ্মি। অদশ্য হলেও এই রশ্মি ‘ক্যাথোড’ বা নেগেটিভ তড়িৎ দ্বারের (negative electrode) বিপরীত দিকের কাচের নলের গায়ে একটি উজ্জ্বল আলোর দাগ (spot) বা প্রতিপ্রভা (fluorescence)-র সৃষ্টি করে। ক্যাথোড রশ্মি সরল পথে চলে এবং নলের বাইরে সামান্য কিছু দূর পর্যন্ত যেতে পারে। কাঁচ ছাড়াও ক্যাথোড রশ্নি বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড (barium platino cyanide) নামক রাসায়নিক পদার্থে মাখানো একটি স্ক্রিন বা পর্দায় (কাচ বা কাগজের বোর্ড দিয়ে তৈরি) এমনি প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করে। অন্যান্য কয়েকজন বিজ্ঞানীর মতো অনেকটা হুজুগে মেতে, অধ্যাপক রন্টজেনও এই ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এসব পরীক্ষার কাজ বিজ্ঞানী ক্রকস (Crookes) সাহেবের উদ্ভাবিত ঐ ‘ক্রকস টিউব’ বা নলে করা হতো।
কিন্তু রন্টজেন একদিন এই ক্যাথোড রশ্মির একটি ধর্ম বা আচরণ সঠিক ভাবে প্রমাণের জন্য তাঁর নিজের তৈরি এক বিশেষ ধরনের কাচের গোলক ব্যবহার করে পরীক্ষা করবেন মনস্থ করলেন। মজার কথা হলো, রন্টজেন যে পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয় নিয়েই গবেষণার কাজে উৎসাহী ছিলেন তা নয়, তাঁর ‘হবি’ ছিল কাচ দিয়ে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করা, আর ফটো তোলা। তবে সত্যি কথা বলতে কি, রন্টজেনের এমনি দুটি বাতিক ছিল বলেই এক্স-রের মতো একটি বিরাট আবিষ্কার করার সৌভাগ্যও তাঁর হয়েছিল।
পরীক্ষার আগে রন্টজেন তাঁর ল্যাবরেটরির সব দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরটিকে অন্ধকার করলেন। তারপর যেই তিনি সুইচ টিপে তাঁর তৈরি ঐ কাচের যন্ত্রটির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালিয়ে দিলেন-অমনি ঘটল এক অবাক কান্ড। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঘরটি যেন জ্যোৎস্নার আলোতে ভরে গেলো। ব্যাপার কি? কোথা থেকে এলো এমন স্নিগ্ধ, কোমল আলো? রন্টজেন অবাক হয়ে দেখলেন কয়েক ফুট দুরে টেবিলের ওপর রাখা বেরিয়াম প্লাটিনো সায়ানাইডের একটি প্লেট জল জল করে জলছে আর সেই প্রতিপ্রভ আলোর প্রভার কারণেই অন্ধকার ঘরটি এমন কোমল আলোতে ভরে গেছে।
অবাক করা কাণ্ড। কেননা, ক্যাথোড রশ্মি অতটা দূরে রাখা পদায় প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করার কথা নয়। কারণটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রন্টজেন তাই সুইচটি ‘অফ' করলেন এবং ক্যাথোড রশ্মি যাতে ঐ পর্দাটি পর্যন্ত কোনো মতেই পৌছাতে না পারে সেজন্য তিনি কাচের গোলকটিকে পুরোপুরি পুরু কালো কাগজ দিয়ে মুড়ে দিয়ে—সুইচটিকে আবার ‘অন’ করলেন। এবারো ঘটালো ঐ একই ভৌতিক কান্ড! পর্দায় পরিস্ফুট হলো ঠিক আগের মতই প্রতিভা আলোর দ্বীপ্তি—আর সারা কক্ষটি জড়ে ঐ মদ, জ্যোৎস্নার আভাস। রন্টজেন কয়েকবার সুইসটি অফ-অন’ করে ঐ একই ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। ব্যাপারটা কেবল অবাক করা নয়—তাঁকে গভীরভাবেই চিন্তিত করে তুললো। তবে কী তাঁর কাচের যন্ত্রটিতে ক্যাথোড রশ্মির সাথে আরো এমন কোনো অদৃশ্য রশ্নির সৃষ্টি হয়েছে-যা এতটাই তীব্র—এতটাই শক্তিশালী যে সেটি পুরু কাগজের বাধা অনায়াসে অতিক্রম করে যেতে পারে? সাধারণ আলো - যাকে বলা হয় ‘দৃশ্যমান আলো’-এমনকি সেই অদৃশ্য ক্যাথোড রশ্মির পক্ষেও যা সম্ভবপর নয় কখনও?
রন্টজেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলেন। রাত-দিন এই অদ্ভুত রশ্মি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, আর নানারকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। উদ্দেশ্য, এই অজানা রশ্মি সম্পকে বিশদভাবে জানতে হবে—উদঘাটন করতে হবে এই অসাধারণ রশ্মির রহস্য।
ভাবলেন-পর কাগজের ভেতর দিয়ে যখন অবাধে যেতে পারে এই রশ্মি তখন অন্যান্য কঠিন জিনিসের বাধাও হয়তো তেমনিভাবেই অস্বীকার করবে এই রশ্মি। নানান জিনিস নিয়ে তাই পরীক্ষা শুরু হলো। দেখলেন, চামড়া, কাঠ, কাপড় প্রভৃতি ভেদ করে এই রশ্মি সহজেই যেতে পারে--কিন্তু ধাতু বা পাথরের জিনিস তার চলার পথে বাধা দেয়। এদের স্পষ্ট ছায়া ভেসে ওঠে বেরিয়াম প্লাটিনো সায়ানাইডের পর্দায়। নিতান্তই কৌতহলী হয়ে একদিন তিনি তাঁর নিজের একটি হাত রাখলেন ঐ যন্ত্র আর পর্দাটির মাঝখানে আর সেই মূহুর্তে যে ঘটনাটি ঘটলো—তা যেমন অভূতপূর্ণ তেমনি এক ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় ঘটনা -যা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে শুধু, পদার্থ বিজ্ঞানে নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসেও।
রন্টজেন দেখলেন পর্দায় কেবল তাঁর হতের ভেতরের হাড়গুলোরই স্পষ্ট ছায়া ভেসে উঠেছে—আর সবই অস্পষ্ট! একে বারে ভোজবাজির মতো তাঁর হাতের অন্যান্য অংশ চামড়া, মাংস, সবকিছুই যেন অনেকটাই উধাও, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে!
এটুকু নিশ্চিত যে-এই দেখাটা বা এই ঘটনাটাই তাঁর জীবনে যেমন সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা, তেমনি তিনি যদি সেদিন কোনো খেয়াল বা কৌতুহলের বশে তাঁর নিজের হাতটি নিয়ে এভাবে পরীক্ষা না করতেন—তবে এই আশ্চর্য ফলাফলটা দেখার সৌভাগ্য যেমন তাঁর হতো না—তেমনি তাঁরই সূত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর নামটি যেখানে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে—সেখানে অন্য কোনো বিজ্ঞানীর নাম যে শোভা পেত—তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এর আগে বলেছি- রন্টগেনের দু’টি বিশেষ বাতিক বা ‘হবি' ছিল। একটি হলো কাঁচ দিয়ে নানা রকমের জিনিস বা যন্ত্রপাতি তৈরি করা আর অন্যটি হলো ফটো তোলা। তাই তার কাজের টেবিলে অনেক সময় পড়ে থাকতো ফটো তোলার নানা সরঞ্জাম। এ ছাড়াও সেখানে থাকতো কিছু, বইপত্র। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা যে সব পরীক্ষায় ফলাফলটা, তাৎক্ষণিক পাওয়া যেত না—অপেক্ষা করতে হতো বেশ কিছুক্ষণ—সে সময় তিনি এই বইগুলোর কোনটি দরকার মতো পড়তেন এবং কতটা পড়া হলো বইটির মধ্যে তার ঘরের একটি ছবি রেখে সে জায়গাটি চিহ্ন দিয়ে রাখতেন।
একদিন এমনি এক পরীক্ষা চলছে। একটি বই-এর খানিকটা পড়ে সেখানটায় যথারীতি তিনি চাবিটি দিয়ে চিহ্ন রেখে-বইটিকে রাখলেন কালো কাগজে মোড়ানো একটি ফটো প্লেটের ওপর। এমন সময় হঠাৎ করে তাঁর মনে পড়লো বাইরের একটা কাজের কথা, তাই ভুলে তিনি তাঁর ক্যাথোড রশ্মি তৈরির কাঁচের যন্ত্রটিকে অমনি চালু অবস্থায় বইটির ওপর রেখে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন বাইরে। ফিরে এসে যখন তিনি দেখলেন যে, ভুলে তিনি সুইচটি অফ করে যান নি-তখন তাড়াতাড়ি সেটি অফ করলেন বটে, কিন্তু তখন তিনি ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেননি, কী অঘটন ইতিমধ্যে ঘটে গেছে ঐ ফটো প্লেটটির
যা হোক, কিছুদিন পর মিসেস রন্টগেনের একটি ফটো তোলার দরকার পড়ায় তিনি ঐ ফটো-প্লেটটিই ব্যবহার করলেন। কিন্তু সেটি ডেভেলপ করে যে নেগেটিভটি পাওয়া গেল সেটিতে দেখা গেল—এক মজার ব্যাপার, মিসেস রন্টজেনের ছবির সাথে দিব্যি শোভা পাচ্ছে-অবিকল রন্টজেনেরর ব্যবহারের সেই চিহ্ন দেয়ার চাবিটির ছাপ।
অবাক কান্ড! নেগেটিভে কী করে এলো ঐ চাবির ছাপ? ওটিতে ছিল বই-এর ভেতরে? ছাত্রদেরকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন—ঐ প্লেটটি নিয়ে তারা কিছু করেছে কি না। সবাই এক বাক্যে অস্বীকার করে বললো-ঐ প্লেট ছোঁয়াতো দুরের কথওটির ত্রিসীমানায় তারা কেউই যায় নি।
নেগেটিভে চাবিটির এমনি ভূতুরে ছবির আবির্ভাবের রহস্যটা জানার জন্য রন্টজেন তাই যতটা স্মরণ করতে পারলেন—সব কিছু ঐ দিনটির পরীক্ষার মতো করে সাজালেন। কালো কাগজে মোড়ানো একটি নতুন ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর রাখলেন একটি মোটা বই—আর সেই বইটির ভেতরে-তার ঘরের চাবিটি। তার পর বইটির ওপরে ক্যাথোড রশ্নি তৈরির যন্ত্রটি রেখে যতটা সময় তিনি বাইরে ছিলেন মনে করতে পারলেন ততক্ষণ ধরেই তিনি বিদ্যুৎ প্রবাহ চালালেন যন্ত্রটির ভেতর দিয়ে। এর পর প্লেটটি যখন ডেভেলপ করা হলো—তখন সেটিতে দেখা গেল বইটির মধ্যে রাখা সেই চাবিটির এক সুস্পষ্ট ছাপ! প্লেটটিতে মিসেস রন্টগেনের ছবি নেই বটে--আর তা থাকার কথাও নয়—তবে ব্যাপারটা তেমনি ভূতুড়ে।
যা হোক, রন্টজেনের এই পরীক্ষায় ভূতুরে ব্যাপারটার রহস্য বেশ বুঝা গেল। বোঝা গেল, আগেরবারের ফটো-প্লেটে কী করে এলো অমন অবাঞ্ছিত চাবির ছাপটা স্পষ্টই প্রমাণিত হলো-ঐ যন্ত্র থেকে নিশ্চয়ই এমন এক অদৃশ্য, অতি শক্তিশালী রশ্মি নিগত হয়েছে—যা বই-এর পাতা গুলোকে অনায়াসে ভেদ করে যেতে পারে কিন্তু লোহার চাবিটিকে তা ভেদ করতে সক্ষম নয়—তাই ফটো-প্লেটে ফুটে উঠেছে ঐ চাবিটির একটি নেগেটিভ ছবি।
এদিকে মিসেস রন্টজেন তো মুখ বেকিয়ে ছিলেন তাঁর মুখের কাছে এক বিরাট চাবির ছাপ দেখে। ওটা যদি কোনো ফুলের ছাপ হতো তবু না হয় একটা কথা ছিল--তা নয়, কোথাকার কোন এক চাবি।
যা হোক, চাবির ছবিটার রহস্য যখন জানা গেল, তখন মিসেসকে কারণটা ভালভাবে বুঝিয়ে কেবল তার রাগটা ভাঙ্গানো নয়-রন্টজেন এক দিন তাঁর একটি হাত ঐ যন্ত্র ও পর্দাটির মাঝখানে ধরে রাখতেও রাজি করিয়ে ছাড়লেন। খুশি হয়ে রন্টজেন সেদিন তাঁর কাচের যন্ত্রে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালিয়ে দিলেন। ওদিকে পর্দায় প্রতিপ্রভা আলো জ্বল জ্বল করে জলে উঠলো। কিন্তু যেমনি মিসেস রন্টজেন তার একটি হাত রাখলেন তাদের মাঝখানে অমনি যে ছবিটি ফুটে উঠলো পর্দায় তাই দেখে ভূত দেখার মতো তিনি চিৎকার করে উঠলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে একটি চেয়ারে বসে পড়ে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ক্ষণিকের জন্য হলেও রন্টজেনও দেখেছিলেন পর্দায় মিসেস রন্টগেনের ঐ হাতের ছবিটা। ওটি যে কোনো হাত তা মনে হয়নি-হাতের ভেতরের হাড়গুলোকেই যেন স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল পর্দায় ফুটে উঠতে।
তবে কী সত্যিই ঐ বই-এর পাতাগুলো যেমন ভেদ করতে পারে ঐ অজানা রশ্মি তেমনি তা ভেদ করতে পারে মানুষের মাংস? বই-এর ভেতরে রাখা লোহার চাবিটির মত কী তবে মানুষের হাতের ভেতরের হাড়ের ছবি পাওয়া যাবে, বাইরে থেকে এত সহজে সব মাংস বাদ দিয়ে জানা যাবে, কেমন ঐ ভেতরের হাড়গুলো—কেমনতর তাদের অবস্থান? আর এমনিভাবে শুধু হাতের নয়, জানা যাবে মানুষের সারা শরীর নিয়ে। এ যে এক বিরাট আবিষ্কার। দারুণ আনন্দের। কিন্তু তার স্ত্রী এমন করে কাঁদছেন কেন? কী হলো তার? কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। কাছে এসে তাই অনুনয় করে বলতে লাগলেন,-“কি হয়েছে? তুমি অমন করে কাঁদছে কেন? তোমার ঐ-হাতের হাড় দেখা যাওয়ার জন্যই তো—আবিস্কৃত হলো এত বড় একটা জিনিস—যা এর আগে আর কেউ জানতে পারেনি—ভাবতে-পারেনি। এতে কাঁদার কি আছে? এতো বড়ই আনন্দের কথা,--দারণ আনন্দের!” কিন্তু এ সব কথায় তাঁর স্ত্রীর কান্না আরো বেড়ে গেল, তারপর এক সময় মুখে তুলে তিনি ধরা গলায় বললেন, একি দেখালে তুমি? আমার হাত, যা তুমি স্পর্শ কর, ভালবাস সেকি শুধু হাড়ে ভরা? আমি কী কেবল একটা কঙ্কাল? আর কিছু নয়? এর পর এই কঙ্কালকে কী করে ভালবাসবে তুমি? পারবে ভালবাসতে?” আর বলতে পারেন না তিনি—ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে-বাড়িতে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর কয়েকদিন ধরে তিনি ছিলেন দারুণ বিমর্ষ-একটি কথাও বলেননি স্বামীর সাথে। এই কাহিনীটি কতটা সত্যি জানি না, তবে আজ যে কারণে বলতে চাইছি তোমাদের কাছে—সেটি হলো মিসেস রন্টজেন সেদিন তার হাতের অমন কঙ্কালসার চেহারাটা দেখে যতই কান্নাকাটি, যতটাই নৈরাশ্যবোধ করন না কেন-সে দিন তাঁর ঐ দেখাটা ছিল এক অপূর্ব দর্শন! আর সেই দেখার ক্ষণটিও ছিল এক স্মরণীয় মুহুর্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন