বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টগেনের এক্স রে আবিষ্কারের গল্প,Wilhelm Conrad Röntgen,discovery of x-ray |
বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টগেনের চাবী ও এক্স রে আবিষ্কারের গল্প - Wilhelm Conrad Röntgen’s key and X-ray
ডানপিটে ছেলে বল্টু সেদিন ক্লাসের ইলেকট্রিক সুইচবোর্ডের তার থেকে সিগারেট ধরাতে গিয়ে বেদম এক শক খেল। খোলা দুটো পজিটিভ-নেগেটিভ তার জুড়ে যে স্পার্ক পাওয়া যায় তা থেকে সিগারেট ধরানো তার আজই কিছু নতুন নয়। কিন্তু, হঠাৎ শকটা খেয়ে চুলছল চোখে তাকে বলতে হয় ? যাই বলিস ভাই, শক জিনিসটা ভারি বিচ্ছিরি!
তার কয়েক দিন পরেই ইলেকট্রিসিটির ক্লাসে প্রফেসর স্পার্কের এক অদ্ভুত কেরামতি দেখালেন। ব্যাপারটা হল এইরকম একটা বন্ধ কাচের নলের দু'পাশে বিদ্যুতের পজিটিভ-নেগেটিভ তার লাগানে আছ। তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের প্রবাহ চালিয়ে দিয়ে যদি ধীরে ধীরে নল থেকে পাম্প করে হাওয়া বের করে ফেলা যায়, তাহলে সারাটা নল উজ্জ্বল আলো দিয়ে জ্বলতে থাকে। শেষটায় নলের বাতাস প্রায় সবই বের করে ফেললে ভেতরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আসে, কিন্তু কাচের নলের গা থেকে বেরুতে থাকে একরকম চমৎকার মৃদু আলো।
ক্লাসে এই অদ্ভুত পরীক্ষাটা দেখবার পর থেকে বিদ্যুতের স্পার্ক সম্বন্ধে বল্টুর ধারণাটা পালটে গেল। সে যখন জানতে পেল, শহরে বড় বড় দোকানে সাইনবোর্ড বা বিজ্ঞাপনের যেসব উজ্জ্বল আলোজ্বলা রঙবেরঙের লেখা, সেগুলো সবই আসলে বৈদ্যুতিক স্পার্কেরই কাণ্ড, তখন এক নতুন জিনিস জানবার আনন্দে তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিদ্যুতের স্পর্কের এইসব রহস্যময় ব্যাপার নিয়ে বেজায় রকম হইচই চলছিল। জার্মানির উর্যবার্গ (Würzburg) শহরে এমনি সব পরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন উইলহেলম কনরাড রন্টগেন নামে একজন বিজ্ঞানী।
রন্টগেনের ধারণা ছিল, ফাঁপা কাচের নল থেকে যে-আলো ছিটকে বেরোয় সে হল আসলে একরকমের উজ্জ্বল বিদ্যুতের কণা। নলের নেগেটিভ বা ক্যাথোড প্রান্ত থেকে সেগুলো ছিটকে বেরোয় বলে তাদের নাম দেওয়া হল ক্যাথোড রশ্মি। সত্যি সত্যি সেগুলো বিদ্যুতের কণা কিনা তার হদিস করার জন্যে একদিন তিনি অদ্ভুত রকমের একটা বাঁকানো নল বানালেন। ইচ্ছে, নলের ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের কণাগুলো বেঁকে যায় কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখা।
অন্ধকার ঘরে ফাপা নলের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে আগের মতোই হালকা সবুজ আলোয় ঘর ভরে গেল। নলটাকে এবার তিনি একটা কালো কাগজ দিয়ে মুড়ে দিলেন, অমনি আলোটাও ঢাকা পড়ল। এতে করে বোঝা গেল, এই আলোর পুরু কাগজ পেরিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই।
রন্টগেন একমনে পরীক্ষা করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। এই আশ্চর্য আলোর রহস্যে তিনি এমন বিভোর হয়ে আছেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথা কিছুই তার মনে নেই। এমনি সময় হঠাৎ তার স্ত্রীর ডাক শোনা গেল, ‘বলি, সারাটা দিন কি উপোস দিয়েই কাটাবে, না খাওয়াদাওয়া আছে!’
রন্টগেন কী আর করেন। পরীক্ষার যন্ত্রপাতি টেবিলের ওপর ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি ছুটলেন খেতে।
খেয়েদেয়ে ফিরে এসে দেখেন, আশ্চর্য! নলটা তখনও তেমনি জ্বলছেই। কী ব্যাপার? না, খেতে যাবার সময় বিদ্যুতের সুইচটা নেবাবার কথা তার মনেই ছিল। না। যাই হোক, একটা মোটা বইয়ের ওপর নলটাকে ফেলে গিয়েছিলেন; সেখান থেকে সেটাকে তুলে নিয়ে তিনি আবার সেই আশ্চর্য আলোর পরীক্ষায় ডুবে গেলেন।
কিন্তু, এবারেও বাধা পড়ল। আবার তার স্ত্রীর গলাঃ সকালে ছবি তুলতে তুলতে রেখে দিয়েছিলে, দেখো এ বেলা কী চমকার রোদ উঠেছে। ক্যামেরাটা নিয়ে একবার বেরোও দেখি! ওসব পরীক্ষা তোমার পরে হবে।
ছবি তোলা রন্টগেনের বেজায় ঝোঁক। বাইরে রোদটাও উঠেছে সত্যি ভারি চমৎকার। কিন্তু ক্যামেরার প্লেটগুলো গেল কোথায়? সকালবেলা সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন আর এখনই বেমালুম উধাও। অনেক খুঁজতে খুঁজতে প্লেটের বাক্সটা শেষকালে পাওয়া গেল টেবিলের ওপর একটা বইয়ের তলায়।
ছবি তিনি তুললেন কতগুলো; তারপর সেগুলোকে ডেভেলপ করলেন। চমৎকার এসেছে দৃশ্যগুলো। কিন্তু অবাক কাণ্ড! একখানা ছবির ওপর এই বিরাট চাবির ছায়াটা আবার এল কোত্থেকে?
রন্টগেনের ছাত্ররাও দেখল তার ছবিগুলো। দেখতে দেখতে একটা ছেলে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ? এ যে স্যার, আপনার অফিসের তালার চাবির মতন ঠেকছে।
তাই তো! কিন্তু সেই হতচ্ছাড়া চাবিটা এখন কোথায়?
সারা ঘরময় তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন—চাবি আর কোথাও পাওয়া যায় না। শেষটায় তার স্ত্রী এলেন সাহায্য করতে তোমার বইপত্রগুলো একটু ঝেড়েঝুড়ে দেখো, কোথাও হয়তো চিহ্ন দিয়ে রেখেছ চাবি দিয়ে। সত্যি সত্যি বড় বইটা ঝাড়তেই তার ভেতর থেকে চাবি বেরল। কিন্তু এবারে মহা ভাবনার ব্যাপার হল। মস্ত মোটা বই-এর ভেতর ছিল চাবি। বই-এর তলায় ছিল প্লেটের বাক্স। আর যখন খেতে গিয়েছিলেন তখন অবশ্য নলটা জ্বলছিল—আর সেটা ছিল বই-এর ওপরে। কিন্ত নল থেকে যে-মৃদু আলো বেরোয় সে তো পুরু কাগজ ভেদ করতে পারে না। তা হলে নল থেকে কি আর কোনো অদৃশ্য রশ্মি বেরোতে পারে যা পুরু মোটা বই আর প্লেটের বাক্সের মোড়ক ভেদ করে তার ওপর চাবির ছাপ ফেলেছে? এ যে অদ্ভুত রহস্যজনক ঠেকছে!
রন্টগেন আবার আগের মতন করে সব কিছু সাজালেন। প্লেটের বাক্সের ওপর বই চাপিয়ে তার মধ্যে চাবি রাখলেন। তার ওপরে বসালেন সেই আলো-দেওয়া নল। তারপর তাঁর খেতে যতটা সময় লেগেছিল ততক্ষণ ধরে ওটাকে অমনি জ্বালিয়ে রাখলেন। প্লেট ডেভেলপ করে দেখা গেল, তার ওপর ঠিক আগের মতোই চাবির ছাপ পড়েছে।
এবারে আর সন্দেহের কোনো কারণ নেই। ওই ক্যাথোড নল থেকে বেরুচ্ছে এক অদৃশ্য রহস্যময় শক্তিশালী রশ্মি। এই রশ্মি সাধারণ আর সব রশ্মির মতো নয়; কেননা এ কাচ, কাগজ বা এ জাতীয় সব জিনিস ভেদ করে যায়। আবার সাধারণ আলোর মতোই ফটোর প্লেটে ছবিও তোলে।
রন্টগেন একদিন এই রশি দিয়ে নিজের হাতের ছবি তুললেন। ছবিতে হাতের চামড়া কুঁড়ে হাড়গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠল। সন্দেহ রইল না যে, এ এক নতুন ধরনের রশ্মি, অদ্ভুত এর গুণপনা। কিন্তু এগুলো যে ঠিক কী, ভেবে ভেবে রন্টগেন তার কোনো হদিস পেলেন না। এগুলো সাধারণ আলো নয়, বিদ্যুৎ নয়, কোনোরকম কণাও নয়—এ একেবারে অজানা আনকোরা নতুন জিনিস। রন্টগেন তাই এদের নাম দিলেন X-ray, অজানা রশ্মি—অঙ্কে যেমন অজানা রাশিকে ধরা হয় ‘এক্স’ বলে। এই ‘এক্স-রে’ নামই ওর আজ পর্যন্ত চলে আসছে।
ফুটবল ম্যাচ খেলতে গিয়ে পা-টা হঠাৎ মচকে গিয়েছে ; ডাক্তার আগে তোমার ভাঙা পায়ের একটা এক্স-রে ছবি তুলে নেবেন—ওই ছবি থেকেই বোঝা যাবে, হাড়টাকে কেমন করে জোড়া লাগাতে হবে। সুমনা খেলতে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের বল গিলে ফেলেছে, এক্স-রে ছবি বলে দেবে সেটা পেটের কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে।
বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টগেনের এক্স রে আবিষ্কারের গল্প,Wilhelm Conrad Röntgen,discovery of x-ray
খুসখুস কাশি, কফের সঙ্গে রক্ত তাড়াতাড়ি বুকটা এক্স-রে করে নাও; দেরি হলে পস্তাতে হবে। মাংস ফুঁড়ে দেখতে পারে বলে এক্স-রে দিয়ে ডাক্তাররা যেন মানুষের শরীরের ভেতর উকি দেবার একটা জানালা খুঁজে পেয়েছেন।
খালি মানুষের শরীরেই নয়, কলকারখানার যন্ত্রপাতিতে আজকাল এক্স-রের সাহায্য না হলে চলে না। এরোপ্লেনের ইঞ্জিন বানানো হচ্ছে, কিন্তু তার ঢালাইতে যদি সামান্য একটু খুতও থাকে তা হলে হয়তো আকাশে উড়তে গিয়ে গোটা এরোপ্লেনটাই এক সময় লোকজনসুদ্ধ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। এক্স-রের ছবি নিয়ে বলে দেওয়া যায়, ভারী যন্ত্রপাতির ভেতরে কোনো খুঁত আছে কি না, থাকলে কোথায় আছে। দামি হীরে মুক্তোর যাচাই করার জন্যে, টাকাকড়ি, ছবির আসল নকল ধরতে, আরও কত শত কাজে যে আজকাল হর-হামেশা এক্স-রে ব্যবহার করা হচ্ছে তা আর বলে শেষ করা যাবে না।
অথচ ১৮৯৫ সালে রন্টগেনের আবিষ্কারের আগে কিন্তু এই রশির কথা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন