আন্দ্রিয়াস ভেসালিউস এর জীবনী - Andreas Vesalius – Life and Works |
আন্দ্রিয়াস ভেসালিউস এর জীবনী - Andreas Vesalius – Life and Works
আন্দ্রিয়াস ভেসালিউস (১৫১৪-১৫৬৪)
চিকিৎসাশাস্ত্রের আজ কতো উন্নতি হয়েছে। মানুষের দেহের অভ্যন্তরে কোথায় কি আছে, কিভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করছে শরীরে, তার সবকিছু আজ মানুষের নখদর্পণে।।
মানুষ তার নিজের শরীর সম্পর্কেই কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত কিছু জানতো না। তাই রোগব্যাধি নিয়ে প্রচলিত ছিলো হাজারো রকমের কুসংস্কার। রোগব্যাধিকে বলা হতো দেবতার অভিশাপ, অপদেবতার আক্রমণ ইত্যাদি। আরো কতো অন্ধ বিশ্বাস।
এই অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চিকিৎসাশাস্ত্রকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার পেছনে যাদের অবদান রয়েছে, তাদের মাঝে বেলজিয়ামের প্রখ্যাত চিকিৎসক আন্দ্রিয়াস ভেসালিউস (Andreas Vesalius) অন্যতম। তিনি শারীরবিদ্যার উপর প্রত্যক্ষভাবে গবেষণা করেন এবং শবব্যবচ্ছেদ করেন।
এর আগে মানুষের উপর যেসব গবেষণা হয়েছে, মানুষের শারীরতত্ত্বের উপর যেসব কথা বলা হয়েছে তার বড় একটা সংখ্যা ছিলো অনুমানভিত্তিক। ইতোপূর্বেকার চিকিৎসকগণ নানা জীবজন্তুর শবব্যবচ্ছেদ করে মানুষের শরীরের কথা অনুমান করে নিতেন। তাই তাঁদের গবেষণা পরিপূর্ণ ছিল না। ভেসালিউস সরাসরি মানুষের দেহ কেটে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের শরীরের রহস্যময় জগৎ সম্পর্কে সঠিক তথ্যের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর চিকিৎসাপদ্ধতি ছিলো নিখুঁত এবং সঠিক তথ্যের উপর নির্ভরশীল।
আন্দ্রিয়াস ভেসালিউসের এই বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হলো দি ফ্যাব্রিকস অব দি হিউম্যান বডি (The Fabrics of the Human Body)। বইটিতে মানবদেহের গঠনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
এই মহান বিজ্ঞানী আন্দ্রিয়াস ভেসালিউসের জন্ম হয় বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে। ভেসালিউসের জন্ম হয়েছিলো এক চিকিৎসক পরিবারে। বাবা নিজেও ছিলেন চিকিৎসক। তাই চিকিৎসক পিতা পুত্রকেও ২০
চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত করে তোলার জন্য লোভনিয়া (Louvnia) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। সেখানে ভেসালিউস ১৫২৯-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মানুষের শারীরতত্ত্বের উপর পড়াশোনা করেন। ভেসালিউসের পিতা ছিলেন রোমের সম্রাট পঞ্চম চার্লস (Charles V) এবং স্পেনের রাজার ব্যক্তিগত গৃহচিকিৎসক।
পিতার ইচ্ছে ছিলো তাঁর পুত্রও নিজেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে মস্তবড় ব্যক্তিত্বরূপে নিজেকে গড়ে তুলুক এবং রাজার ঘনিষ্ঠতা লাভ করে প্রচুর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হোক। তিনি পুত্রকে সেভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ভেসালিউস প্যারিসের মেডিক্যাল স্কুল অব দি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার কাজে যোগদান করলেন।
এখানেই তিনি প্রখ্যাত শারীরতত্ত্ববিদ জ্যাকোবাস সিলভিয়াস (Jacobus Sylvius) এবং গুইন্টারিয়াস এন্ডারনাচাস (Guinterius Andernachus)-এর কাছে পশুদেহের অস্ত্রোপচার শিক্ষা করেন। উল্লেখ্য যে, ইউরোপে তখনো সরাসরি মানুষের দেহে অস্ত্রোপচার করে চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষাদান বা চিকিৎসা করার পদ্ধতি চালু হয়নি। সেখানে মানবদেহের খুঁটিনাটি জানার জন্য পশুদেহকেই ব্যবহার করা হতো।
কিন্তু ভেসালিউস এতে খুশি হতে পারলেন না। তিনি সাহস করে নিজের উদ্যোগেই আরো এক ধাপ অগ্রসর হলেন।
তিনি নিজে মানুষের মৃতদেহকে ব্যবচ্ছেদ করেন। নানা ধর্মীয় কুসংস্কার এবং নৈতিকতাবোধের কারণেই তাঁর পূর্বেকার ডাক্তারগণ এমনটা করার সাহস করেননি।
এ সময় ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট পঞ্চম চার্লস এবং ফরাসি সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস (Francis-1)-এর মধ্যে একটি যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে যেসব সৈনিক মারা যেতো সেখান থেকেই লোক দিয়ে মৃতদেহ সংগ্রহ করে আনতেন ভেসালিউস। পরের বছর তিনি ফিরে আসেন নিজের দেশে এবং লোভনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। লোভনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ভারতীয় এবং আরব মুসলিম বিজ্ঞানীগণ যেসব গবেষণা করে গেছেন তার উপর পড়াশোনা করেন।
১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দশম শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ আররাজি (Ar Razi)-এর উপর গবেষণা করেন এবং তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যাচেলার ডিগ্রী লাভের জন্য আররাজির উপর থিসিস তৈরি করেন।
এরপর তিনি একজন দক্ষ শল্যচিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন পাড়ুয়া (Padua) বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রী লাভ করেন।
ভেসালিউস বিশ্বাস করতেন, মনুষ্যশরীরের অভ্যন্তরভাগের সবকিছু খুঁটিনাটি না জেনে কেউ কখনো শল্যবিদ হতে পারে না। একথা তিনি তাঁর ছাত্রদেরও বলতেন। শুধু বলা নয়, শল্যচিকিৎসশাস্ত্রে আরো দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনিও প্রায় সর্বক্ষণ মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কেউ কেউ বলেন, এই সময় নাকি ভেসালিউস প্রায় সর্বক্ষণই মৃতদেহ কাটাছেঁড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এটা তাঁর একটা প্রচণ্ড নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো।
তিনি বলতেন, অনুমাননির্ভর ডাক্তার হতে নেই, এ কাজে থাকতে হবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
ভেসালিউসের সময়কাল পর্যন্ত ইউরোপে চিকিৎসা এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর যে জ্ঞান ছিলো তার মূল ভিত্তি ছিলো গ্যালেনের [১৩০-২০০] দেয়া থিওরি। সেটা ছিলো অনেকখানি গল্পকাহিনীর মতো এবং গ্যালেন মনে করতেন মানুষের শরীরে যে রোগব্যাধি হয় তা ঈশ্বরের নির্দেশেই হয়। কিন্তু ভেসালিউসই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যেই গ্যালেনের মতবাদের বিরোধিতা করলেন। তিনি ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে বোলোগনা (Bologna) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণের সময় নিজেই নিজের শরীরে অস্ত্রোপচার করে দর্শকদের দেখিয়ে বিস্মিত করেন এবং গ্যালেন মতবাদের প্রতিবাদ করে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজের অভিজ্ঞতালদ্ধ মতবাদ।
তিনি গ্রন্থের ভিতরে মানবদেহের বিভিন্ন অংশের ছবি অঙ্কনের জন্য সহযোগিতা গ্রহণ করেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী টিসিয়ানের (Titian)। ভেসালিউসের ‘দি ফ্যাব্রিক অব দি হিউম্যান বডি' গ্রন্থটি ছিলো শল্যচিকিৎসার উপর একটি নির্ভরশীল ও তথ্যবহুল গ্রন্থ। এটি প্রকাশিত হয় ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে।
তিনি তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থটির এক কপি রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসকে উপহার দেয়ার জন্য রোমে আসেন। রাজা চার্লসও যুবক ভেসালিউসের গবেষণাকর্মে খুব খুশি হন এবং তাঁকে রাজপরিবারের চিকিৎসক হিসেবে মনোনয়ন দান করেন। এই সময় ভেসালিউসের বয়স ছিলো মাত্র ২৮ বছর।
আর এমনি করেই ভেসালিউস জীবনের শুরুতেই রাজার সান্নিধ্য লাভ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করেন। তাঁর পিতার স্বপ্ন পরিপূর্ণতা লাভ করে। ভেসালিউস ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে অ্যানেভ্যান হ্যাম (Annevan Hamme) নামে এক বিদেশি মহিলাকে বিয়ে করে সংসার পাতেন।
এরপর থেকে ভেসালিউস অধ্যাপনার কাজে ইতি টানেন। নিযুক্ত হন রাজ চিকিৎসক। রাজার সাথে সর্বক্ষণ থেকে থেকে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন নানা দেশ।
১৫৫৩ থেকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের অধিকাংশ সময় অবশ্য তিনি ব্রাসেলসেই অতিবাহিত করেন। এখানেই তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখেন।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তাঁকে আজীবন পেনসন দান করেন এবং রাজসভার কাউন্ট নিযুক্ত করেন। এরপর সম্রাট চার্লস মারা গেলে তাঁর পুত্র ফিলিপ দ্বিতীয় (Philip-II) তাঁকে মাদ্রিদ-এর প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত করেন। তিনি এই নতুন পদে যোগদানের জন্য ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রী এবং কন্যাসহ সেখানে আসেন।
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা ফিলিপের অনুমোদন নিয়ে খ্রিস্টানদের তীর্থভূমি পবিত্র শহর জেরুজালেম সফরে আসেন। ভেসালিউসের জীবনের সর্বশেষ ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো পবিত্র তীর্থস্থান জেরুজালেম থেকে জাহাজযোগে ইটালি ফেরার পথেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থ অবস্থায়ই তাঁকে গ্রীসের জ্যাকিনথাস (Zacynthus) শহরে আনা হয় এবং এখানেই তিনি ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন