রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

আধুনিক মুদ্রণশিল্পের জনক জোহান্স গুটেনবার্গ এর জীবন - Johannes Gutenberg – Life and Works

 

আধুনিক মুদ্রণশিল্পের জনক জোহান্স গুটেনবার্গ এর জীবনী - Johannes Gutenberg – Life and Works
আধুনিক মুদ্রণশিল্পের জনক জোহান্স গুটেনবার্গ এর জীবনী - Johannes Gutenberg – Life and Works

আধুনিক মুদ্রণশিল্পের জনক জোহান্স গুটেনবার্গ (১৩৯৫-১৪৬৮) - Johannes Gutenberg Life and Works

এক নজরে জোহান্স গুটেনবার্গ

পূর্ণ নামঃ Johannes Gensfleisch zur Laden zum Gutenberg

জন্মঃ (১৩৯৫/১৪০০ ১৪৬৮) মেইঞ্জ, জার্মানী (রোমান সাম্রাজ্য)

পেশাঃ খোদাইকারী, উদ্ভাবক, মুদ্রাকর, স্বর্ণকার, জহুরী

খ্যাতিঃ উন্নত ও আধুনিক মুদ্রণশিল্পের জনক

মানবসভ্যতার আজ বিপুল অগ্রগতি হয়েছে, মানুষ জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে অর্জন করেছে চরম সাফল্য। এর মূলে রয়েছে মুদ্রণশিল্প। মুদ্রণশিল্পের যদি প্রসার না ঘটতো তাহলে সভ্যতা এতো দ্রুত বিকাশ লাভ করতে পারতো না। আর এই মুদ্রণশিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে যে-ব্যক্তিটির সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে তিনি হলেন জার্মানের একজন কর্মকার এবং আবিষ্কারক জোহান্স গুটেনবার্গ (Johannes Gutenberg). গুটেনবার্গই সর্বপ্রথম পুণর্ব্যবহারযোগ্য ধাতব টাইপ আবিষ্কার করে মুদ্রণ-শিল্পের ক্ষেত্রে এক যুগান্তর এনেছেন।

অবশ্য চীনে সর্বপ্রথম মুদ্রণশিল্পের উম্মেষ ঘটে। পরবর্তীতে যখন আরবের মুসলিমদের মাঝে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং সাধারণ মানুষের জন্যে ব্যপক হারে বই ছাপানো দরকার হয়, তখন তারাও এই শিল্পের ব্যপক উন্নতি সাধন করেন (চাইনিজ ও আরবদের অবদান লিঙ্ক)। 

জোহান্স গুটেনবার্গ এর উদ্ভাবনের আগে কাঠ খোদাই করে অক্ষর তৈরি করা হতো। সেই অক্ষর হাতে তৈরি কাগজের উপর স্ট্যাম্পের মতো ছাপ মেরে মেরে বই ছাপা হতো। কিন্তু সেখানে এই অক্ষর আলাদা ছিল না। এগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা যেতো, আর এগুলো দিয়ে অধিক সংখ্যক বইও ছাপা যেতো না।

দীর্ঘদিন পর জার্মানির কর্মকার গুটেনবার্গই সর্বপ্রথম ধাতব অক্ষর তৈরি করেন, যেগুলো সম্পূর্ণ আলাদা তৈরি হতো এবং বহুবার ব্যবহার করা যেতো। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সমস্ত লেটার প্রেসগুলো গুটেনবার্গের পদ্ধতিতেই অক্ষর তৈরি করত এবং ছাপার কাজ চালায়।

তাই বলতে হয় সেই পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষসীমা পর্যন্ত মুদ্রণশিল্পকে টেনে আনার পেছনে গুটেনবার্গের কৃতিত্বই ছিলো সবচেয়ে বেশি। সভ্যতার অগ্রগতিতে তাঁর দান অবিস্মরণীয়। এই কৃতিসন্তান গুটেনবার্গের জন্ম হয়েছিলো জার্মানির মাইনজ (Mainz) নামক শহরে ১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে; একেবারেই এক সাধারণ পরিবারে। বাল্যকালে দু'-চারদিন স্কুলে গেলেও শিক্ষা খুব একটা অগ্রসর হয়নি তাঁর। কিশোর বয়সেই পেটের দায়ে চাকরি নিতে হয়।

তিনি এক স্বর্ণকারের সহকারী হিসেবে কাজ নেন। কিন্তু এই কাজটিই তাঁর জন্য বয়ে এনেছিলো সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। স্বর্ণকারের কারখানায় সোনার অলঙ্কার ছাড়াও আরো অনেক ধাতবদ্রব্য তৈরি হতো । গুটেনবার্গ এই ধাতব কারখানায় থাকার ফলে বাল্যকাল থেকেই বিভিন্ন ধাতুর গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

মাইনজে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি চলে আসেন জার্মানির স্ট্রাসবুর্গ (Strassburg) নামক শহরে। এখানে তিনি আরো বড় একটি স্বর্ণকারের কারখানায় কাজ নেন। এখানেও নানারকম ধাতব বস্তু তৈরি হতো।

স্ট্রাসবুর্গে তিনি ছিলেন ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। এখানে প্রথমে তিনি চাকরি নিয়ে এলেও পরে কারখানার অংশীদার হয়ে যান এবং নিজের উদ্যোগে মণিমুক্তা কাটার এবং আয়না তৈরি করার একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। গুটেনবার্গ ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ কারিগর। তিনি তাঁর কাজকর্মের গোপন খবর অন্য কাউকে জানতে দিতেন না। কিন্তু কিছুদিন পরেই গুটেনবার্গের এই গোপন করার কৌশল জানাজানি হয়ে যায়।

তিনি ১৪৩৮ খ্রিস্টাব্দে নতুন কারখানার একজন পার্টনার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন । গুটেনবার্গের অন্যান্য পার্টনারদের মধ্যে ছিলেন হ্যান্স রিফ (Hans Riffe), আড্রেজ ড্রিজেন (Andreas Dritzehn) এবং আন্দ্রেস হেইলম্যান (Andreas Heiman) নামের ব্যক্তিগণ।

পাঁচ বছর মেয়াদী এই চুক্তিতে বলা হয় তাঁদের চারজন পার্টনারের মধ্যে যদি কেউ মারা যান তাহলে তাঁর উত্তরাধিকারীরা কেউ আর পার্টনার হতে পারবেন না। তবে তাঁরা পার্টনারের অংশীদার হিসেবে লাভের ন্যায্য অংশ পাবেন। কিন্তু কোম্পানির কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।

কিছুদিন পরেই পার্টনার আড্রেস ড্রিজেন মারা যান এবং তাঁর পত্নী কোম্পানিতে অংশগ্রহণের দাবিতে আদালতে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ড্রিজেনের পত্নী মামলায় হেরে যান। কারণ এমন কথা তো দলিলে নেই। মামলায় হেরে গেলেও ড্রিজেনের স্ত্রী এই বলে আবার আপীল মামলা করলেন যে, গুটেনবার্গ মুদ্রণশিল্পের একটি নতুন আবিষ্কারের উপর কাজ করছেন। কি কাজ সেটা অবশ্যই তাঁদের জানবার অধিকার আছে। এ ব্যাপারে মহিলা গুটেনবার্গেরই কারখানার জনৈক কামারকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করালেন।

এ ছাড়াও হ্যান্স ডান (Hans Dunne) নামে জনৈক স্বর্ণকার এই বলে ঘোষণা দিলেন যে, তিনি গত ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে গুটেনবার্গের কাছে ১০০ ডলারের কিছু মুদ্রণসামগ্রী বিক্রি করেছেন।

এদিকে গুটেনবার্গ সত্যি সত্যি গোপনে তাঁর আবিষ্কারের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং তাঁর ভয় ছিলো এই ধাতব টাইপ আবিষ্কারের কথা বাইরে জানাজানি না হয়ে যায়। ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর আবিষ্কারের কথা গোপনই ছিলো। অত্যন্ত সংগোপনেই তিনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এরপর ১৪৪৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে তিনি চলে এলেন নিজের শহর মাইনজের কারখানায়। এবার তিনি তাঁর আবিষ্কারকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চান। প্রতিষ্ঠা করতে চান একটি আধুনিক প্রেস। কিন্তু তেমন একটি প্রেস নিতে প্রচুর টাকার দরকার। তাই তিনি একজন অর্থ যোগানদারের সন্ধান করতে লাগলেন। অবশেষে পেয়েও গেলেন। জোহান ফাস্ট (Johan Fust) নামে জনৈক ধনী ব্যক্তি প্রেস স্থাপন করার জন্য গুটেনবার্গকে ৮০০ ডলার দিতে রাজি হলেন।

অতঃপর স্থাপিত হলো বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক ছাপাখানা। ফাস্টের মূলধন দিয়ে গুটেনবার্গ তাঁর ছাপাখানার জন্য টাইপ তৈরির ধাতু ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনলেন।

এর দুবছর পর ফাস্ট আরো ৮০০ ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করে গুটেনবার্গের ছাপাখানার পার্টনার হলেন। গুটেনবার্গের ছাপাখানা কিন্তু ফাস্টের সাথে গুটেনবার্গের বনিবনা হলো না। ফাস্ট চাইছিলেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বেশি বেশি কাজ করে বেশি বেশি পয়সা আয় করা হোক, যাতে রাতারাতি ধনী হওয়া যায়। কিন্তু গুটেনবার্গের ছিলো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি চাইতেন কাজ কম হোক, আয় কম হোক, কিন্তু কাজ নিখুঁত হওয়া চাই। সুনাম ও দক্ষতাই বড় কথা, ব্যবসা বড় কথা নয়। দুজনের দুরকম দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই তাঁদের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে গেলো।

অতঃপর ফাস্ট তাঁর বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চেয়ে গুটেনবার্গের নামে মামলা ঠুকে দিলেন। মামলায় হেরে গেলেন গুটেনবার্গ এবং আদালত তাঁকে ২,০২৬ ডলার ফেরত দানের রায় ঘোষণা করলো। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে গুটেনবার্গ একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেলেন।

এই সময় গুটেনবার্গের ছাপাখানায় তাদের ধর্মগ্রন্থ ছাপা হচ্ছিলো। ফাস্ট মামলায় জিতে গিয়ে পুরো প্রেসের মালিকানা হস্তগত করে বসলেন এবং যে টাইপে ছাপা হচ্ছিল সেগুলোও পেয়ে গেলেন।

গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত টাইপ এবং প্রেসের অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর দখল পেয়ে এবং গুটেনবার্গকে রাস্তার ফকির করে ছেড়ে দিয়ে ফাস্ট এবার জমিয়ে বসলেন প্রেস ব্যবসায়। ফাস্টকে সহায়তা করলেন গুটেনবার্গেরই লোকেরা। তাঁর জামাতা এবং তাঁর নিজের হাতে শিক্ষা দেয়া দক্ষ কারিগর পিটার স্কোফার (Peter Schoffer)। তাঁর সাথে অবশ্য আরো একজন ছিলো। এ লোকটাও তাঁরই নিজের লোক। প্রেসের কর্মচারী। এ লোকটার আরো একটি পরিচয় হলো ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে যখন ফাস্ট গুটেনবার্গের বিরুদ্ধে মামলা করছিলেন তখন সে গুটেনবার্গের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলো। এই বিশ্বাস ঘাতকতার পুরস্কার হিসেবে ফাস্ট তাকে চাকরিতে বহাল করেন।

এ প্রেস থেকেই সারা বিশ্বের সর্বপ্রথম ধাতব টাইপে মুদ্রিত যে পুস্তক প্রকাশিত হয় সেখানে মুদ্রাকরের নাম হিসেবে ছাপা হয়েছিলো জোহান ফাস্ট এবং পিটার স্কোফারের নাম। যদিও গুটেনবার্গ থাকার সময় থেকেই এর ছাপার কাজ শুরু হয়েছিল, গুটেনবার্গ নিজেই শুরু করেছিলেন নিজের আবিষ্কৃত টাইপের দ্বারা, কিন্তু বইটি যখন ছাপা শেষ হয় তখন তাঁর নাম ছিলো না। বইটি মুদ্রিত হয় ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট তারিখে।

গুটেনবার্গের কোনো কোনো জীবনীকার দাবি করেন যে, বইটি মামলার আগেই ছাপা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এটা ছিলো গুটেনবার্গের নিজস্ব সম্পদ। অথচ তাঁর যখন ঋণ পরিশোধের সময় সম্পত্তির হিসেব ধরা হয়, তখন ছাপা বই বাইবেলকে হিসেবে ধরা হয়নি। পরে ছাপা বইটিই প্রতারণার মাধ্যমে মুদ্রাকরের নাম পাল্টে গুটেনবার্গের পরিবর্তে ফাস্ট-এর নাম ছাপা হয়। ওটা ফাস্টের সম্পত্তি হয়ে যায়। বইটি যে গুটেনবার্গের নিজের হাতেরই ছাপা ছিলো, তার অনেক প্রমাণ আছে। এতে শুধু ছাপা নয়, মেটাল দিয়ে সুন্দর ব্লক তৈরি করে নানারকম নকশাও তৈরি করা হয়েছিলো, যা একমাত্র গুটেনবার্গের মতো দক্ষ লোক ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। গুটেনবার্গ মামলায় হেরে গিয়ে প্রেসের কর্তৃত্ব হারান ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ নভেম্বর। আর বইটি প্রকাশিত হয় ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট। এত অল্প সময়ের মধ্যে ফাস্টের মতো অদক্ষ লোকের পক্ষে অতবড় বই ছেপে বের করা সম্ভব ছিলো না, বইটি আগেই ছাপা ছিলো।

মামলায় হেরে গিয়ে গুটেনবার্গ যখন নিঃস্ব অবস্থায় পথে পথে ঘুরছিলেন তখন এগিয়ে এলেন মাইনজ-এর আরেক ধনী ব্যক্তি ডঃ কনরাড হোমারি (Dr. Kanrad Humery)। তিনি গুটেনবার্গের দক্ষতার কথা এবং তাঁর প্রেস আবিষ্কারের কথা আগেই শুনেছিলেন। তাই এই দক্ষ লোকটিকে কাজে লাগানোর জন্য এগিয়ে এলেন। তিনি আবার গুটেনবার্গকে মূলধন যোগান দিলেন নতুন প্রেস তৈরি করার জন্য।

গুটেনবার্গ এই অনুদান গ্রহণ করেছিলেন এবং নতুন উদ্যোগে একটি প্রেস দাঁড় করানোর চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি সফলকাম হতে পারেননি। বয়স বেড়ে গিয়েছিল। শক্তি-সামর্থ্যও কমে এসেছিলো।

তার চেয়ে বড় কথাচোখ দুটো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তিনি ভালোমতো দেখতে পেতেন না শেষ বয়সে। এদিকে তাঁর ঋণ দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছিল। অবশেষে মাইনজের কয়েকজন সদাশয় ব্যক্তি তাঁর থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব বহন করেন।

এমনি করে শেষজীবনে ঋণে জর্জরিত হয়ে পরের দয়ায় দুঃসহ জীবন নিয়ে আরো কিছুদিন বেঁচেছিলেন তিনি। অবশেষে ১৪৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন