জোহান্স কেপলার এর জীবনী - Johannes Kepler – Life and Works |
জোহান্স কেপলার এর জীবনী - Johannes Kepler – Life and Works
জোহান্স কেপলার (১৫৭১-১৬৪০)
সৌরজগতের গ্রহনক্ষত্র নিয়ে প্রচলিত ছিলো হাজারো রকমের বিভ্রান্তি । অ্যারিস্টটলীয় যুগ থেকে এই ধারণা প্রচলিত ছিলো যে, সৌরজগতের কেন্দ্রবিন্দু হলো পৃথিবী। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাস এই বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্বের বিরোধিতা করেন-পৃথিবী নয়, সৌরজগতের কেন্দ্রবিন্দু সূর্য। পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে সূর্যকেই প্রদক্ষিণ করছে।
বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলার (Johannes Kepler) এই গ্রহ প্রদক্ষিণের গতিধারার নিয়ম (Planetary motion) সূত্রায়িত করেন। তিনি সৌরজগতের কোন গ্রহ কত গতিবেগে এবং কত দূর থেকে সর্যকে প্রদক্ষিণ করছে তার সূত্র নির্ণয় করেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলারের জন্ম হয়েছিলো দক্ষিণ জার্মানীর ওয়রটেমবার্গের (Wurttemberg) ওয়েইল (Weil) নামক স্থানে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে। বাবা ছিলেন সরাইখানার মালিক। কিন্তু দোকানের মালিক হলে কি হবে, অবস্থা খুব ভালো ছিলো না। আসলে কেপলারের বাবার নিজের স্বভাবটাই ভালো ছিলো না। মতিগতি ঠিক ছিলো না। ব্যবসাপাতির দিকে আদৌ কোনো নজর ছিলো না তাঁর। শুধু বসে বসে হাতিঘোড়া মারতেন আর হাতে টাকা এলেই উড়িয়ে দিতেন। ব্যবসার উন্নতির দিকে খেয়াল করতেন না।
যেমনি বাপ তেমনি ছিলো মায়ের অবস্থা। কেপলারের মাও ছিলেন বদরাগী মহিলা। আসলে অপদার্থ স্বামীর সাথে খিটখিট করতে করতেই তাঁরও মেজাজ গিয়েছিলো বিগড়ে। সারাক্ষণ রেগে থাকতেন।
পারিবারিক এই বিরুদ্ধ পরিবেশেও কেপলার বেড়ে উঠতে লাগলেন একটু ব্যতিক্রমভাবে। হোটেলওয়ালার ছেলে, বড় হয়ে তাঁরও তো হোটেলের কাজেই লেগে পড়ার কথা ছিলো। কিন্তু তাঁর মধ্যে দেখা দিলো ভিন্ন রকম লক্ষণ। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখা গেলো তাঁর। ছাত্রও ভালো ছিলেন। তাই বাবার মনে হলো, ছেলেটা বড় হয়ে হয়তো-বা সমাজের কিছু একটা হতে পারে। তাই ধর্মশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার জন্য তাঁকে পাঠানো হলো টুবিংগল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে বাল্যকালে কেপলারের আবার একটা অসুবিধাও দেখা দিয়েছিলো। মাত্র চার বছর বয়সেই তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কোনোরকমে সেরে উঠলেও তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
এ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই তাঁর শরীর এমনিতেও দুর্বল ছিলো। বাবা-মা মনে করলেন তাঁদের ছেলে হয়তো শক্ত কোনো কাজ করতে পারবে না। যদি ধর্মশাস্ত্র শিক্ষা করতে পারে তবে গির্জায় চাকরি হবে। সেখানে খাটুনিও কম। এসব চিন্তা করেই তাঁকে ধর্মশাস্ত্র পড়তে পাঠানো হয়েছিলো। এ সময় তাঁর বয়স ছিলো ১৭ বছর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেই জনৈক অধ্যাপকের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। এই অধ্যাপকের কাছে তিনি নিকোলাস কোপারনিকাসের সৌরমণ্ডলীয় সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা শোনেন।
এই সূত্রের দ্বারাই কোপারনিকাস প্রাচীন বিজ্ঞানী টলেমির ভূকেন্দ্রীয় সূত্রটি (Glocentric Theory) বাতিল করে দেন। টলেমি মনে করতেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থান করছে পৃথিবী। পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করছে। কোপারনিকাস এই মতবাদকে খণ্ডিত করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র। তাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলো পরিক্রম করে চলেছে। এটি হেলিওসেনট্রিক সূত্র (Heliocentric Theory) নামে পরিচিত।
(যদিও বর্তমানে আমরা জানি সৌরজগৎ জিওসেন্টিক বা হেলিওসেন্ট্রিক কোনটিই নয়)
তিনি ধর্মশাস্ত্র পাঠ করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে গণিতশাস্ত্রটিও তাঁর ভালো লেগে যায়। অধ্যাপক সাহেবের সংস্পর্শে এসেই তাঁর গণিতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অবশেষে তিনি ধর্মশাস্ত্রের পাশাপাশি গণিতশাস্ত্রও পড়তে থাকেন। দুটোই চলতে থাকে একসাথে। তিনি দিনরাত ডুবে থাকতেন পড়াশোনায়।
ধর্মশাস্ত্র ও তাঁর ভালো লাগতো। কিন্তু অধ্যাপক ও অন্যান্য কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে তিনি গণিতের উপরই বেশি জোর দেন। তাই কেউ কেউ পরবর্তীকালে কেপলারের গণিতশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন—কেপলার যদি গণিতশাস্ত্র ছেড়ে ধর্মশাস্ত্র নিয়েই পড়াশোনা করতেন, তা হলে নিউটনের আর্বিভাব অনেক যুগ পিছিয়ে যেতো। অবশেষে তিনি গণিতশাস্ত্রেই উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তারপর ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে গণিতের অধ্যাপক হিসেবেই গ্রাৎস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
কেপলারের সময় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন জ্যোতির্বিদ এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি কেপলার নিজেও বিশ্বাস করতেন আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের গতি এবং অবস্থান মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই তখনকার দিনে জোতির্বিদগণ জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চাও করতেন। কেপলার নিজেও গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি ও তাদের অবস্থান নিয়ে পড়াশোনা এবং দেশের রাজা ও দেশ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন।
কেপলারের সময় পর্যন্ত সৌরজগতের পৃথিবী বাদে মাত্র পাঁচটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছিলো। যথা—বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি। অপরদিকে সুষম ক্ষেত্রও ছিলো পাঁচটি ও যথা—চার, পাঁচ, আট, বারো এবং কুড়ি বাহুযুক্ত। কেপলারই প্রথমে লক্ষ করেন যে, এই পাঁচটি গ্রহ এবং পাঁচটি সুষম ক্ষেত্রের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অঙ্কের গণনার সাহায্যে তিনি গ্রহের গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র নির্ধারণ করেন। এই নিয়ম তিনটি হলো:
১. কক্ষ সম্পর্কিত নিয়ম বা পরিক্রমা পথঃ সূর্য উপবৃত্তের (Elipse) কেন্দ্রস্থানে অবস্থিত বলে সমস্ত গ্রহই সূর্যের চারপাশে ডিম্বাকারে বা উপবৃত্তীয় কক্ষপথে (Elliptical Orbits) ঘোরে। বৃত্তীয় কক্ষে (Circular Orbits) ঘোরে না।
এটিই কক্ষ-সম্পর্কিত নিয়ম বলে পরিচিত। কোনো বেলুন বা সিলিন্ডারকে তার কক্ষের সাথে কোণাকুণিভাবে প্রস্থচ্ছেদ করলে উপবৃত্তীয় আকার পাওয়া যায়।
২. ক্ষেত্রফলের নিয়মঃ সূর্য থেকে গ্রহের ঘূর্ণনকালে টানা দূরক রেখা (Radius Kictor) সমান সমান সময়ে সমান সমান ক্ষেত্রফল আবৃত করে। এই সূত্র থেকেই এটি প্রমাণ করে যে সূর্যের চারপাশে গ্রহের পরিক্রমণের গতিবেগ সূর্যের থেকে তার দূরত্বের উপর নির্ভরশীল। গ্রহটি যখনি সূর্যের কাছাকাছি হয় তখন তার গতিবেগ বেড়ে যায়, যেমন দূরত্ব বাড়ে তেমন গতিবেগও কমতে থাকে।
৩. দূরত্বসংক্রান্ত নিয়ম ও কোনো গ্রহের সূর্যের চারপাশে পরিক্রমণের সময়ের বর্গ, সূর্য থেকে তার গড় দূরত্বের ঘনকের সমানুপাতিক হয়। এ সূত্রটি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। সূর্যের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে বুধ গ্রহের সময় লাগে ৮৮ দিন এবং পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ।
এ দুটো সংখ্যার বর্গ যথাক্রমে ৭৭৪৪ এবং ১৩৩২২৫। দ্বিতীয় সংখ্যাটি প্রথম সংখ্যাটি অপেক্ষা ১৭ গুণ বেশি। আনুপাতিক হিসেব ১:১৭। সূর্য থেকে গড়ে বুধ গ্রহের দূরত্ব ৩,৬০,০০০ মাইল এবং পৃথিবীর দূরত্ব ৯,৩০,০০০ মাইল। এবং সংখ্যাগুলোর ঘনক হলো ৪৬,৬৫৬ এবং ৮,০৪,৩৫৭। এ সংখ্যা দুটোর অনুপাতও অনেকটা কাছাকাছি অথাৎ ১ ঃ ১৭।
এই তিনটি সূত্রের আবিষ্কারের সাথে সাথেই কেপলারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তিনি বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
কেপলার তখন এতো বেশি খ্যাতির অধিকারী হয়ে যান যে, ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে (Tycho Brahe) তাঁর সহকারী হওয়ার জন্য তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানান। তবে ইতোপূর্বেই কেপলারের জীবনে বেশ কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে গেছে। তিনি ছিলেন ধর্মবিশ্বাসে প্রোটেস্টাইন। গ্রাৎস বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেন। শুধু বিরূপ হওয়াই নয়, কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তাঁকে চাকরি পর্যন্ত ছাড়তে হলো।
উল্লেখ্য যে, সেকালে ধর্মের সাথে চাকরিরও একটা নিকট সম্পর্ক ছিলো। পরে অবশ্য কেপলার তাঁর প্রতিভা এবং বিশ্বজোড়া খ্যাতির জন্য চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর ফিরে যাননি। কারণ তাঁর যেসব প্রিয় ছাত্র ছিলো তারাও ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে গেছে। তাই সেখানে আর মন টিকলো না তাঁর। এবার তিনি নিজেই দিলেন চাকরি থেকে ইস্তফা।
এরই মধ্যে তিনি টাইকো ব্রাহের কাছ থেকে পেলেন আমন্ত্রণ। তিনিও সানন্দে গ্রহণ করলেন এই আমন্ত্রণ। কারণ এতোবড় একজন বিজ্ঞানীর সাথে কাজ করার আগ্রহ তাঁরও ছিলো। তারপর ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহের মৃত্যুর পর তাঁরই আসনে সমাসীন হলেন কেপলার এবং সেই সাথে প্রাচ্যের সম্রাট রুডলফ (প্রথম]-এর রাজসভায় অবৈতনিক জ্যোতির্বিদের পদও লাভ করলেন। এতোবড় পদ পাওয়ার পরও কেপলারের জীবনে তেমন একটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি। কারণ তিনি বিজ্ঞান গবেষণার কাজ নিয়েই শুধু ব্যস্ত থাকতেন। অর্থের দিকে কোনো মোহ ছিলো না তার। এই জন্যই খ্যাতি হলেও অর্থ তেমন আসেনি।
পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র সম্পর্কে গবেষণার কাজও তিনি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন। তিনি বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর সমসাময়িক ছিলেন। দুই মনীষী নিজেদের বিজ্ঞান গবেষণার বিষয় নিয়ে পরস্পর পত্রও আদানপ্রদান করতেন।
কেপলারের ব্যক্তিগত জীবন ছিলো সাধারণ। তিনি ২৬ বছর বয়সে স্টিরিয়ার এক ধনী মহিলাকে বিয়ে করেন। কিন্তু ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রী মারা যান। তারপর তিনি এক অনাথ মেয়েকে বিয়ে করেন। দুই পক্ষ মিলে কেপলারের সন্তান সংখ্যা ছিলো ১২টি। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর তারিখে কেপলার মৃত্যুবরণ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন