শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১

আধুনিক বিজ্ঞানের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা রজার বেকন (১২১৪-১২৯৪) - Life of Roger Bacon

রজার বেকন এর জীবনী -  Life of Roger Bacon
রজার বেকন এর জীবনী -  Life of Roger Bacon
 

আধুনিক বিজ্ঞানের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা রজার বেকন (১২১৪-১২৯৪)-  Life of Roger Bacon

বিজ্ঞান আজ উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু বিজ্ঞানকে এতোদূর পৌঁছে দিতে বিশ্বের যেসব মনীষী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সারা জীবনের সাধনা দিয়ে যারা এর মূল ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রজার বেকন (Roger Bacon)।

রজার বেকনই বলতে গেলে আধুনিক বিজ্ঞানের মূল স্থপতি। বিজ্ঞানের বহু শাখা আজ চরম সফলতা লাভ করেছে। কিন্তু তার অনেক কিছুরই মূল ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলেন রজার বেকন।

মহাকাশযান আজ আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিরাট বিস্ময় কিন্তু এই মহাকাশযান বা রকেট আবিষ্কারের গোড়াতে রজার বেকনের বিরাট অবদান আছে। রকেটের মূল ভিত্তি আতশবাজি। বিভিন্ন বিস্ফোরণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আতশবাজি তৈরি হয়। আতশবাজির মূল উপাদান ব্ল্যাক পাউডার (Black Powder)। ঐতিহাসিকগণ বলেন, রজার বেকন নামে জনৈক ইংরেজ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীই প্রথম ব্ল্যাক পাউডার আবিষ্কার করেন। বেকনই সর্বপ্রথম ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে ল্যটিন ভাষায় আতশবাজির নির্মাণকৌশল এবং বিভিন্নরকম বিস্ফোরকের মিশ্রণ সম্পর্কে লেখেন। সে থেকেই এর উন্নতি শুরু।

প্রাচীন দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রজার বেকনের জন্ম হয়েছিলো বৃটেনে ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আজ আর সঠিকভাবে কিছু জানার উপায় নেই। স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য এসে ভর্তি হয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে প্যারিসে এসেও পড়াশোনা করেছিলেন বেশ কয়েক বছর। রসায়নশাস্ত্রে উচ্চডিগ্রী লাভ করার পর তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।

রজার বেকন ছিলেন অসম্ভব রকমের মেধাবী এবং প্রতিভাবান। তিনি তাঁর যুগের তুলনায় ছিলেন চিন্তাচেতনায় বহু শতাব্দীর ব্যবধানে অগ্রগামী। তিনি বিজ্ঞানের সেই প্রাথমিক যুগে বাস করেও এমন সব ধ্যানধারণা পোষণ করতেন যা তখনকার লোকেরা কল্পনাও করতে পারত না। তিনি সেই ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই এমন সব সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা তখন কেউ ভাবতেও পারেনি। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সবকিছুই আবিষ্কৃত হয়েছিলো তাঁর মৃত্যুরও বহু শতাব্দী পরে।। তিনি একাধারে ছিলেন ভাষাবিদও। গ্রীক এবং আরবি ভাষাও ভালো জানতেন।

কেউ কেউ বলেন তিনি যে ব্ল্যাক পাউডার আবিষ্কার করেছিলেন, তার মূল সূত্র তিনি পেয়েছিলেন আরবি গ্রন্থ থেকে। রজার বেকনের আগেই আরব মুসলিম বিজ্ঞানীরা বারুদজাতীয় পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন। আরবরা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ব্ল্যাক পাউডারের উন্নয়ন ঘটায়। আরবি গ্রন্থ থেকে রজার বেকন এই ব্ল্যাক পাউডারের মূল সূত্র গ্রহণ করেন এবং তার উন্নয়ন করেন। তবে মূলত তিনিই ব্ল্যাক পাউডারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দান করেন। 

রজার বেকন এর জীবনী -  Life of Roger Bacon - roger bacon cartoon - রজার বেকন কার্টুন
রজার বেকন এর জীবনী -  Life of Roger Bacon - roger bacon cartoon - রজার বেকন কার্টুন

ঐতিহাসিকগণ আরো বলেন, বারুদের আদি আবিষ্কার নাকি আরবদের নয়। বারুদ সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিলো চীনে। চীন থেকে এটা আরবরা আয়ত্ত করে এবং সেখান থেকে ব্রিটেনের বিজ্ঞানী রজার বেকনের হাতে এটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বিকশিত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে রজার বেকনের মতাদর্শ ছিলো অ্যারিস্টটলীয় যুগের। গ্রন্থপাঠ করে মুদু তত্ত্বজ্ঞান আহরণ করে লাভ নেই, তার চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের চর্চা করা শ্রেয়। তিনি কখনো ভাববাদী আদর্শে বিশ্বাস করতেন না। হাতেকলমে প্রমাণ না পেলে তা মেনে নিতেন না। যা কিছুই হোক, তা অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে ।

তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক। তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে বারো শোর উপরে। এর মধ্যে অন্যতম ব্ল্যাক পাউডার। এ ছাড়া তিনি গান পাউডার (Gun Powder) নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি চুম্বকদণ্ডও (Magnetic needle) তৈরী করেন। তারপর দূরবীক্ষণ (Telescope)-এর গঠন কাঠামো নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। তবে দূরবীক্ষণের সত্যিকার আবিস্কারক হলেন আবুল হাসান ইবন ইসহাক। তিনি রজার বেকনেরও অনেক আগেই এটি আবিস্কার করেন।

ষোড়শ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম ম্যাগেলান ভূ-প্রদক্ষিণ করে আসার পরই হাতেনাতে প্রমাণিত হয় যে পৃথিবী গোলাকার। অথচ এরও তিনশো বছর আগেই রজার বেকন বিশ্বাস করতেনপৃথিবী গোলাকার। তিনি বলেছিলেন, আটলান্টিক মহাসাগর ধরে পশ্চিম দিকে জাহাজ চালিয়ে গেলে এশিয়া মহাদেশে পৌঁছানো যাবে। এরও অনেক পরে ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে কলম্বাস এশিয়া মহাদেশে পৌঁছোনোর উদ্দেশ্যে আটলান্টিক মহাসাগর ধরে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছিলেন। তিনি এশিয়া মহাদেশে পৌছোতে পারেননি সত্য, কিন্তু আবিস্কার করেছিলেন আরেক পৃথিবীআমেরিকা মহাদেশ। এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী তিনি আরো করেছিলেন, যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের কথা তখনো মানুষ কল্পনাও করতে পারত না। কিন্তু তিনি তাঁর অস্বাভাবিক মেধাশক্তি ও দূরদর্শিতা দিয়ে এদের আবিস্কারের আগাম খবর জানিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলেছিলেন, এমন একদিন আসবে যেদিন সমুদ্রের বিশাল জাহাজ চালাতে আর মানুষের দরকার হবে না। শুধু একজন মানুষের পক্ষেই একটি জাহাজকে অনায়াসে চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। রজার বেকন এর দ্বারা যান্ত্রিক জাহাজের কথা বলেছিলেন। অথচ তখনো যান্ত্রিক জাহাজের কথা কেউ কল্পনাও করেনি। রজার বেকনের যুগেও জাহাজ চলত পালের সাহায্যে। অথচ সেই যুগে তিনি এমন অগ্রিম চিন্তা করতেন। শুধু সামুদ্রিক জাহাজ নয়, ডাঙার গাড়ি নিয়েও তিনি এমনি একটি আগাম কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এমন দিন আসবে যেদিন গাড়ি টানার জন্য আর ঘোড়া কিংবা গরু-মহিষের দরকার হবে না। তখন এর গতি হবে অনেক দ্রুত। জল এবং ডাঙার পর তিনি আকাশযানের কথাও বলেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যেদিন তৈরি হবে এক বিচিত্র জাতের মেশিন, যা পাখির মতো আকাশে উড়তে সক্ষম হবে। শুধু মেশিন একাই আকাশে উড়বে না, তাতে মানুষও চড়তে পারবে এবং মেশিন পরিচালনা করতে পারবে। মজার ব্যাপার হলো, রজার বেকনের কল্পনার এই উড়ন্ত মেশিন উদ্ভাবিত হয়েছিলো বিংশ শতাব্দীর শুরুতে।

তিনি এমনি আরেকটি চমকপ্রদ মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে নদীর উপর এমন চমৎকার সেতু তৈরি হবে, যাতে কোনো খুঁটি বা থাম থাকবে না।

তিনি সম্ভবত আধুনিক ঝুলন্ত সেতুর কথা বলেছিলেন। রজার বেকনের মৃত্যুর সাড়ে সাতশো বছর পরে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ঝুলন্ত সেতুর কারিগরি কৌশল উদ্ভাবন সম্ভব হয়। 

গ্রীক ও আরব মুসলিম বিজ্ঞানীদের চিন্তা ও গবেষণাকর্ম তিনি অধ্যয়ন করেন। জ্ঞানের প্রশ্নে ধর্মযাজক এর বানীর চেয়ে গ্রীক ও আরব বিজ্ঞানীদের যুক্তি ও গবেষণা কাজকে অধিক মূল্যবান ঘোষণা করায় যাজক সম্প্রদায় তার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বৈজ্ঞানিক আবিস্কার নিয়ে যে অদ্ভুত সব মন্তব্য তিনি করতেন তা কিন্তু মজা করার জন্য তিনি বলতেন না। তিনি এসব শুধু মুখে বলতেন না। এই সব ব্যাপারে রীতিমত যুক্তিতর্ক দিয়ে লিখিত আকারে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে বলতেন। কিন্তু তখনো সাধারণ মানুষ তাঁর এই বহু শতাব্দীর অগ্রগামী চিন্তাধারা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। এমনকি দেশের বিজ্ঞানী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরাও তাঁর এসব উদ্ভট কথা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তারাও তাঁকে এ ধরনের উদ্ভট কল্পনা ছড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য বলতেন। কিন্তু তিনি শুনতেন না। এর ফলে তাঁর প্রতি লোকেরা ক্ষেপে গেলো। অনেকেই তাঁর শত্রু হয়ে গেলো। তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও রজার বেকন গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের উপর রচনা করতে লাগলেন একের পর এক গ্রন্থ।

তিনি একটানা ১৮ মাস লিখে রচনা করলেন এক বিশাল গ্রন্থ। তখনো তো মুদ্রণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বই বলতে বোঝানো হতো হাতে লেখা বই। তখন ছিললা না লেখারও কোনো সরঞ্জাম। তবু তিনি রাতদিন খেটে তৈরি করলেন তাঁর গবেষণা গ্রন্থসমূহ।

তাঁর এই গ্রন্থগুলোর নাম ছিলো ওপাস মাজুস (Opus Majus), ওপাস মিনাস (Opus Minus) এবং ওপাস টারটিয়াস (Opus Tertius)। এই সবগুলো গ্রন্থই তিনি রক্ষণাবেক্ষণ ও পঠনের জন্য পাঠালেন তাঁর একমাত্র শুভাকাঙক্ষী পোপ ক্লিমেন্টের কাছে। পোপ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন শত্রু তাঁর কোনো ক্ষতি করার সাহস পায়নি। দূরে থেকে সমালোচনা করেছে। হয়তো গালাগালও দিয়েছে, কিন্তু গায়ে হাত দেবার সাহস কারো হয়নি। কিন্তু ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে পোপ ক্লিমেন্টের মৃত্যুর পরই রজার বেকনের বিপদ ঘনিয়ে এলো। এতোদিন যারা তাঁর প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলো, শত্রুতা করতো, তারা এবার তাঁকে অসহায় পেয়ে আক্রমণ করে বসলো। প্রভাবশালী শত্রুদের চক্রান্তে তিনি এবার গ্রেফতার হলেন। তাঁকে ধরে বিচার করে জেলে পাঠানো হলো। তিনি জেলে ছিলেন একটানা চোদ্দ বছর। তবে জেলেও তিনি বসে ছিলেন না। জেলে বসেও চালিয়ে গেছেন তাঁর গবেষণা বই লেখা।

অনেক পরে নতুন পোপ নিকোলাস ৪র্থ (Nicholas-IV) এলেন। তিনিও ছিলেন ক্লিমেন্টের মতোই গুণগ্রাহী।

এবার রজার বেকন তাঁর জেলে বসে লিখিত বইগুলো পাঠিয়ে দিলেন নিকোলাস এর কাছে। নিকোলাস তাঁর জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ পাঠ করে খুবই চমৎকৃত হলেন এবং তাঁকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য রাজাকে অনুরোধ করলেন। রজার বেকন মুক্ত হলেন।

জেল থেকে যখন বেরিয়ে এলেন তখন তাঁর প্রায় বৃদ্ধ বয়স। তবু তাঁর ছিলো অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য। তিনি আবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করলেন। শুরু হলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা।

কিন্তু মনের উৎসাহ থাকলেও শরীর তাঁর ভেঙে পড়েছিলো। তিনি আর আগের শক্তি ফিরে পেলেন না। তারপর ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই অক্সফোর্ডেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বিজ্ঞানজগৎ তাঁকে স্মরণ করবে চিরকাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন