অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর জীবনী – Life of Albert Einstein |
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর জীবনী – Life of Albert Einstein
আইনস্টাইনের জীবনাবসানের পর এক বিখ্যাত সংবাদপত্রে একটি সুন্দর ছবি প্রকাশিত হয়। তার ক্যাপশনে লেখা ছিল, মহাকাশে অসংখ্য ছায়াপথ-নক্ষত্র-গ্রহ ধাবমান। শুধু একটির গায়েই লেখা “এখানে আইনস্টাইন বাস করতেন।”
আইনস্টাইনকে দিয়েই অনন্ত মহাবিশ্বে এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর পরিচয়। সাধারণ মানুষের কাছে আইনস্টাইনের নাম এমন এক শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানবোধ জাগ্রত করে যার তুলনা হয় না। তার আপেক্ষিক তত্ত্ব মননশীলতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই তত্ত্ব যে কী, তা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই দুর্বোধ্য। শিক্ষিত মানসে আইনস্টাইন হলেন আধুনিক নিউটন। এই দু’জনে ভৌত বিশ্বজগৎকে তার নিগূঢ়তম মৌলিক উপাদানে বিশ্লেষণ করেছেন এবং প্রকৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।
তাদের মাঝে আরো তুলনা করা যায়। দু’জনকেই যৌবনে বোঝা যায়নি যে, একদিন তাদের গলায় প্রতিভার জয়মালা শোভা পাবে। নিউটন ক্ষেতের কাজ করতেন এবং তাঁর মেধা তখনই পরিস্ফুট হয়, যখন তিনি কেমব্রিজে স্নাতক পড়াশোনা শেষ করলেন। আইনস্টাইন প্রায় ড্রপ-আউট বা ঝরে-পড়াদের দলে নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউই জানত না এবং তিনি অজ্ঞাতই ছিলেন, যতদিন না তাঁর প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয়। স্নাতক ছাত্র হিসেবে নিউটনও অপরিচিতই ছিলেন যদিও লুকাসিয়ান অধ্যাপক আইজাক ব্যারোর মনে তিনি গভীর ছাপ রাখতে পেরেছিলেন। ছাত্রের প্রতিভা বুঝে শিক্ষক নিজেই পদত্যাগ করে নিউটনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে সুপারিশ করেন। অন্যদিকে আইনস্টাইন কারো মনে বিশেষ কোনো দাগ কাটতে পারেননি। তাঁকে একটি সহকারীর পদেও কেউ আমন্ত্রণ জানায়নি এবং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অস্টওয়ার্ল্ডের কাছে পত্র দিয়েও আইনস্টাইনের পিতা কোনো উত্তর পাননি। আবার এই অস্টওয়াল্ডই ১৯১০ সালে আইনস্টাইনের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেন।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পিতামাতা হেরমান এবং পলিন ছিলেন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন জার্মান ইহুদি। হেরমানের আর্থিক সংগতি খুব বেশি ছিল না এবং ব্যবসাবুদ্ধি ছিল আরো কম। উলম শহরে ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ অ্যালবার্ট জন্মগ্রহণ করেন। এক বছর পরে হেরমান তার পরিবার নিয়ে মিউনিখ শহরে এসে বিদ্যুৎ-রসায়নের ব্যবসা শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই আইনস্টাইন ছিলেন সম্পূর্ণ অন্তর্মুখী। তার কথা বলতে এত দেরি হয়েছিল যে, পিতামাতা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। অ্যালবার্ট ছিলেন নীরব, স্বাপ্নিক প্রকৃতির বালক, যে খেলাধুলা বেশি পছন্দ করে না এবং যার চালচলনেও এমন একটা ধীরস্থির ভাব, যা বয়স্কদের বিরক্তি উৎপাদন করে। ধর্মের ব্যাপারে পিতামাতা ছিলেন উদার। তাই তাঁরা পুত্রকে কাছাকাছি একটি ক্যাথলিক স্কুলে পাঠালেন, যেখানে তিনিই ছিলেন শ্রেণীতে একমাত্র ইহুদি বালক। কিন্তু জার্মান বিদ্যালয়ের যান্ত্রিক শৃঙ্খলা তার কাছে অসহ্য মনে হতো এবং তাই দশ বছর বয়সে তাকে লুইটপোল্ড জিমনাসিয়ামে ভর্তি করে দেয়া হলো। এখানেও তার অভিজ্ঞতা ছিল একই। তবু এখানেই তিনি বারো বছর বয়সে জ্যামিতির একটি বই পেয়ে সবটাই একবারে পড়ে ফেললেন। জ্যামিতিক উপপাদ্যের শৃঙ্খলা আর যুক্তি তার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল।
অ্যালবাটের বয়স যখন পনেরো, তখন তার পিতার ব্যবসায়ে আরেকবার বিপত্তি নেমে এল। মিলানে সুযোগ বেশি পাওয়া যাবে ভেবে পিতামাতা ছোটবোনসহ সেখানে চলে গেলেন। অ্যালবার্টকে কিছুটা গোড়া এক আত্মীয়ের বাসায় রেখে যাওয়া হলো। স্কুলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবের অভাব এবং অস্বস্তিকর পারিবারিক পরিবেশ সব কিছুই অ্যালবার্টকে মিউনিখ থেকে চলে যেতে উদ্বুদ্ধ করল। একজন শিক্ষক তাঁকে স্পষ্টই বললেন যে, তাঁর কিছুই হবে না। সুতরাং তার স্কুল পরিত্যাগ করাই উচিৎ। কেননা, তার উপস্থিতি শিক্ষক এবং ছাত্রদের মানসিক শান্তি নষ্ট করে। আইনস্টাইন খুব খুশি হয়ে ইতালির সূর্যালোকিত মুক্ত প্রান্তরের দিকে ছুটে গেলেন। মিলানেও হেরমানের ব্যবসায় তেমন ভালো চলছিল না। সচ্ছল আত্মীয় স্বজনদের সহায়তায় অ্যালবার্ট জুরিখের ফেডেরাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তির আবেদন করলেন, কিন্তু জিমনাসিয়ামের ডিপ্লোমা না থাকায় তাঁকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হলো এবং সেখানে তিনি ব্যর্থ হলেন। সুতরাং তাঁকে আবার আরাওর স্কুলে ভর্তি হয়ে তার অনুপপত্তি দূর করতে হলো। এরপর অবশ্য পলিটেকনিকে ভর্তি হতে তার আর অসুবিধা হলো না। ভর্তি হওয়ার পর, যেহেতু বিষয়গুলো সবই গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত, তাই আইনস্টাইন সকলের চেয়ে ভালো করবেন এটাই আশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয়নি। গণিতের এত বিভিন্ন অংশ দেখে তিনি বুঝতেই পারলেন না কোনটা বেশি দরকারি। তাই স্থির করলেন যে, কোনোটাই তার দরকার নেই। পদার্থবিজ্ঞানে অবশ্য তাঁর বিশেষ অসুবিধা হয়নি, কিন্তু শ্রেণীকক্ষের শৃঙ্খলা যেহেতু তার কাছে অসহ্য মনে হতো, তাই তিনি তাঁর নিজের ঘরে বসেই পড়াশোনা করতেন। বন্ধু মার্সেল গোসমানের ক্লাসের নোট তাঁকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করল।
১৯০০ সালে স্নাতক হওয়ার পর আইনস্টাইন শিক্ষক হিসেবে কোথাও চাকরি পেলেন না। দু’বছর তিনি বদলি শিক্ষকের কাজ বা ছাত্রদের কোচিং ইত্যাদি করেই জীবনধারণ করলেন। এরপর গ্রোসমানের পরিবারের সাহায্যে তিনি বার্ন শহরে পেটেন্ট অফিসে পেটেন্ট-পরীক্ষক তৃতীয় শ্রেণী হিসেবে একটি চাকরি পেলেন। এখানেই আইনস্টাইন একটা মোটামুটি সন্তোষজনক জায়গা পেলেন, যেখানে নিশ্চিন্তে কাজ করার সময় পাওয়া যায়। তাঁর এই নিঃসঙ্গ চিন্তার ফসলই হলো ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তিনটি অসাধারণ প্রবন্ধ, যার যে কোনো একটির জন্যেই আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতেন। এর প্রথমটিতে তিনি প্ল্যাঙ্কের শক্তির কোয়ান্টামের ধারণা সম্প্রসারণ করে আলোক-কণার ধারণা সৃষ্টি করলেন। যার মাধ্যমে আলোক-বিদ্যুৎ বা ফটো ইলেকট্রসিটি প্রতিভাসের সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ব্রাউনীয়গতির ওপর, যা গ্যাসের অণুর বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে প্রবাহীর মধ্যে ভাসমান বস্তুকণার গতি থেকে গ্যাস অণুর আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা দিল। এবং তৃতীয় প্রবন্ধ ছিল আপেক্ষিকতার ওপর, যা আমাদের দেশকালের ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে।
আইনস্টাইনের এই তিনটি প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য পরবর্তী বছরগুলোতে অসংখ্যবার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সুপ্রমাণিত হয়েছে। ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি, বলা যায় যে, একলাই ধারণাজগতে এক বিপ্লব এনে দিলেন। এসব ধারণা সৃষ্টি করার সময়ে তিনি পেটেন্ট অফিসের সামান্য একজন কর্মচারী এবং গবেষণাজগতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সশ্রমবিহীন। বহু বছর পরে আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, “৩০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী কখনও চোখে দেখেননি।” মনে হয় গবেষণাজগতে তাঁর ধারণাসমূহ যাচাই করার কোনো প্রয়োজনীয়তা তিনি কখনও অনুভব করেননি, কেননা তাদের সঠিকতা সম্বন্ধে তার মনে কখনও কোনো সন্দেহ ছিল না।
কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯১০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত আইনস্টাইনের অবদান নিয়ে কেবলই আলোচনা করেছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ১৯২২ সালে কমিটি ১৯২১ সালের পুরস্কারটি তাঁকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় “তার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে অবদান, বিশেষ করে, আলোকবিদ্যুৎ প্রক্রিয়ার আইনটি আবিষ্কারের জন্য।”
লক্ষ্যণীয় যে, আপেক্ষিক তত্ত্বের জন্য আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়নি। কারণ, এই তত্ত্বের (বিশেষ এবং সাধারণ) পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণ যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। নোবেল কমিটির বিশেষজ্ঞ গালস্ট্রান্ড ছিলেন শারীরতত্ত্ববিদ এবং আরেহেনিয়াস রসায়নবিদ—উভয়ই আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বিরোধিতা করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্য বারবার আইনস্টাইনের নাম করেছেন। ব্রিলোয়ার ভাষায়, “আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে মানুষ কী মনে করবে, যদি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় আইনস্টাইনদের নাম না থাকে।”
১৯০৯ সালের দিকেই আইনস্টাইনের অবদান ধীরে ধীরে বিদ্বৎসমাজে পরিচিতি এবং স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। ক্রাকাউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকই নাকি প্রথম আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর প্রবন্ধ পাঠ করে মন্তব্য করেছিলেন, “একজন নতুন কোপারনিকাস জন্মগ্রহণ করেছে।”
বার্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রথমে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দান করে। এখান থেকে তিনি জুরিখে সহযোগী অধ্যাপকের পদে কিছুদিন কাজ করার পর প্রাগে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু স্ত্রী মিলেভার প্রাগ শহর পছন্দ নয় বলে তিনি ১৯১২ সালে আবার জুরিখের পলিটেকনিকে ফিরে আসেন। পরের বছর প্ল্যাঙ্কের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিনি বার্লিনে কাইজার ভিলহেলম্ ফিজিকাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেন। বার্লিনে আসার পরপরই মিলেভার সঙ্গে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে যায় এবং নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর পুরস্কারের সমুদয় অর্থ (তিরিশ হাজার ডলার) তিনি মিলেভাকে দিয়ে দেন। কিছুদিন পর তিনি তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া এলসার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন, যদিও সত্যিকার অর্থে আইনস্টাইন সারাজীবন একলাই ছিলেন।
আমি বাস্তবিকই নিঃসঙ্গ। কোনোদিনই আমি সারা অন্তর দিয়ে রাষ্ট্র, জন্মভূমি, বন্ধু-বান্ধবের চক্র, এমনকি ঘনিষ্ঠ পরিবারেব মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। বরং এসব সম্পর্কই আমার মধ্যে সবসময়ে একটা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি এবং একাকীত্বের প্রয়োজনীয়তাবোধ এনে দিয়েছে।
আইনস্টাইনের গবেষণা বিশাল পরিধি থেকে একটা কথাই স্পষ্ট যে, তাঁর প্রতিটি কাজই গভীরভাবে মৌলিক। একটা অসাধারণ ক্ষমতা তার ছিল, যা দিয়ে তিনি প্রতিটি সমস্যার মূলে যেতে পারতেন। ধরা যাক আলোককণা বা ফোটনের কথা। যদিও ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের বর্ণালি-বণ্টন থেকে শক্তিগুচ্ছ বা কোয়ান্টামের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন, তবু এই কোয়ান্টাম নিয়ে তিনি নিজে বেশি স্বস্তিতে ছিলেন না। তার ধারণা ছিল শুধু বিকিরণ নিঃসরণ আর শোষণের সময়েই শক্তিগুচ্ছের প্রয়োজন হয় কিন্তু অন্য সময়ে বিকিরণ তরঙ্গ প্রকৃতির। আইনস্টাইন এই আধাআধি অবস্থা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়ে বললেন, “বাস্তবিকপক্ষে আমার মনে হয় যে, পরীক্ষণলব্ধ ফল ব্যাখ্যা করা যায় শুধু এই অনুমান থেকেই যে, বিকিরণের শক্তি মহাকাশে বিচ্ছিন্নভাবে বিন্যস্ত।”
আইনস্টাইন প্রমাণ করলেন যে, বিকিরণকে আলোককণা বা ফোটন হিসেবে নিয়ে তার ওপর সংখ্যাতত্ত্ব প্রয়োগ করলেই প্ল্যাঙ্কের আইন পাওয়া যায়, যে আলোককণার শক্তি তার কম্পাঙ্ক এবং প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের গুণফলের সমান। অর্থাৎ “এক রঙা বিকিরণ এমনভাবে আচরণ করে, যেন তা পৃথক স্বতন্ত্র শক্তি কোয়ান্টা দিয়ে তৈরি।”
আলোককণা বা ফোটনের সবচেয়ে সুন্দর প্রমাণ হলো আলোক-বিদ্যুৎ প্রতিভাস অর্থাৎ আলো যখন ধাতুর ওপর পড়ে তখন ধাতু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়, কিন্তু নিঃসৃত ইলেকট্রনের গতিশক্তি আপতিত আলোর তীব্রতার ওপর নির্ভর করে না বরং তার রঙের ওপর নির্ভর করে। আইনস্টাইনের ভাষায়, “সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হলো এই যে, প্রতিটি কোয়ান্টাম তার সমগ্র শক্তি একটিমাত্র ইলেকট্রনের কাছেই হস্তান্তরিত করে। সুতরাং ইলেকট্রনের গতিবেগের বণ্টন.....আপতিত বিকিরণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে না, কিন্তু নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যা আপতিত বিকিরণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে।”
এই সহজ ব্যাখ্যার জন্যই আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি নিঃসন্দেহে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব যা একটিমাত্র মানুষের মনীষার একক সৃষ্টি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম দেশকালের জ্যামিতির সঙ্গে প্রকৃতির আইন জড়িত করে দেয়া হলো এবং তার ফলে হেরমান ভাইলের ভাষায়, “মনে হয় সত্যের কাছ থেকে যে দেয়াল আমাদের আলাদা করে রেখেছিল তা যেন ভেঙে পড়ল।”
সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ভিত্তি কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে ফিরে যেতে হয়। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, যদি অভিকর্ষ বল না থাকে এবং দর্শক ত্বরণহীন হয় তাহলে সব জড় কাঠামো (পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব গতিবেগে ধাবমান সব স্থানাঙ্ক) সমতুল্য এবং প্রকৃতির আইন প্রকাশ করার জন্য সমানভাবে ব্যবহারযোগ্য। অর্থাৎ কোনো পরম জড় কাঠামো (স্থির ইথার)-এর অস্তিত্ব নেই। সব জড় কাঠামো সমতুল্য এবং আলোর গতিবেগ ধ্রুব - এই দুটি ধারণা নিয়েই বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের সৃষ্টি এবং এখন আর পরম সময়, পরম স্থান, পরম গতি, পরম যুগপত্তি ইত্যাদির সব ধারণার কোনো অর্থ হয় না।
কিন্তু যতক্ষণ জড়কাঠোমোকে প্রকৃতির বিশেষ প্রসঙ্গ কাঠামো বলে মনে করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আপেক্ষিক তত্ত্বের মধ্যে অভিকর্ষ আনা যায় না। কেননা, অভিকর্ষ বল বস্তুতে ত্বরণের সৃষ্টি করে এবং এমন কোনো জড়কাঠামো নেই, যেখানে অভিকর্ষের অধীনে বস্তুর সুষম গতিবেগে ধাবমান। সুতরাং বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের সম্প্রসারণ বা সাধারণীকরণ প্রয়োজন, যদি আমরা অভিকর্ষ বল তত্ত্বে আনতে চাই। আইনস্টাইন লক্ষ করলেন যে, বস্তুর জড়জনিত ভর অর্থাৎ যা দিয়ে সে আরোপিত বলের বিরুদ্ধতা করে এবং অভিকর্ষভর, যার ফলে বস্তুর ওজনের সৃষ্টি হয়--- এই দুই ভর সম্পূর্ণ সমান। জড়ভর এবং অভিকর্ষভরের সমতা একটা পরীক্ষিত সত্য এবং আইনস্টাইন এই সমতাকে সমতুল্যতার নীতি আখ্যা দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের একটা প্রয়োজনীয় নীতির মর্যাদা দিলেন। যেহেতু জড়ভর এবং অভিকর্ষভর সমান তাই অভিকর্ষ ক্ষেত্র এমনভাবে আচরণ করে যেন অভিকর্ষ বল হিসেবে কিছুই নেই বরং আছে শুধু অজড় কাঠামোর ত্বরণ, যার ফলে জড়ভর আমরা অনুভব করি।
অন্যভাবে বলা যায় যে, সমতুল্যতার নীতি এটাই দাবি করে যে, জড়ভর এবং অভিকর্ষ বল পরস্পরের মধ্যে বদলাবদলি করা যায় কেননা, ক্ষুদ্র অঞ্চল। এই দুই বল সমান। সুতরাং ক্ষুদ্রস্থানে অভিকর্ষ ক্ষেত্র বাতিল করে দেয়া যায় একটা উপযুক্ত ত্বরণের সৃষ্টি করে, যেমন মুক্ত পতনশীল লিফট অথবা ঘূর্ণনশীল মহাকাশযানের ব্যবস্থা করে। অর্থাৎ কোনো দর্শক যাকে অভিকর্ষ বল হিসেবে দেখবেন অন্য একজন দর্শক তাকে জড়জনিত বল হিসেবে দেখতে পারেন।
বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে অনুমান করা হয়েছিল যে, এক জড় কাঠামো থেকে অন্য জড় কাঠামোয় লোরেন্ৎস রূপান্তরের (Lorentz transformations) মাধ্যমে গেলে প্রকৃতির আইন একইরূপে প্রকাশিত হবে। কিন্তু অভিকর্ষ বল বা ত্বরিত প্রসঙ্গ কাঠামো ব্যবহার করলে একথা আর সত্য থাকে না। সেক্ষেত্রে প্রকৃতির আইনের প্রকাশ এমন হতে হবে, যাতে তারা সবচেয়ে সাধারণীকৃত স্থানাঙ্ক রূপান্তরের অধীনে অপরিবর্তিত থাকে, শুধু লোরেন্ৎস রূপান্তরের অধীনে নয়।
সাধারণ স্থানাঙ্ক রূপান্তরের অর্থ হলো এই যে, এখন আর নিউটনের বলের ধারণারই প্রয়োজন হয় না। নিউটনের গতির প্রথম আইন থেকে আমরা জানি যে, বস্তু সরল রেখায় সুষম গতিতে চলে, যতক্ষণ না তার ওপর কোনো বল আরোপ করা হয়। অর্থাৎ বস্তুর ওপর সক্রিয় বলের অস্তিত্ব বোঝা যায় তার সরল রৈখিক গতি থেকে বিচ্যুতি দেখে। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে বলা হয় যে, বিচ্যুতির কারণ কোনো বল নয় বরং রৈখিক গতি থেকে বিচ্যুতি আসে অন্তনিহিত জ্যামিতির পার্থক্য থেকে। অর্থাৎ মুক্ত বস্তু মহাকাশ জ্যামিতির বৈশিষ্ট্যময় ‘সরল রেখা’য় চলে। কিন্তু অভিকর্ষের উপস্থিতিতে মহাকাশের জ্যামিতি ইউক্লিডিয় নয়। সুতরাং, নিউটন যাকে অভিকর্ষ বল আখ্যা দিয়েছেন, আসলে তা মহাকাশের অ-ইউক্লিডিয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয়। এভাবেই আইনস্টাইন অভিকর্ষের জ্যামিতিক ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছিলেন।
মনে রাখা দরকার যে, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের জগৎ ইউক্লিডিয় জগতের চতুর্মাত্রিক জগতের সম্প্রসারণ মাত্র। অর্থাৎ এখানে মহাকাশ সমতলীয়। সুতরাং একই যুক্তিতে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের জগৎ অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতির বক্র জগৎ। উদাহরণস্বরূপ, সমতল দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠতলের ওপর মুক্ত বস্তুকণার গতি সরল রৈখিক । কিন্তু দ্বিমাত্রিক বক্র পৃষ্ঠতলে (যেমন গোলকের ওপরে) বস্তুকণা পৃষ্ঠতলের বক্রতাই অনুসরণ করে। বক্র মহাকাশের তত্ত্ব গাউস, রিমান এবং অন্যান্য গণিতবিদরা আগেই সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। এই গণিত (টেন্সর ক্যালকুলাস) ব্যবহার করে আইনস্টাইন একগুচ্ছ সমীকরণ পেলেন, যাদের বলা হয় আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণ। প্রথম আসমানে আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণ থেকে নিউটনের অভিকর্ষ আইন পাওয়া যায়, যার ফলে দুইশত বছর পরে নিউটনের অভিকর্ষ তত্ত্বের ভিত্তি পাওয়া গেল। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর আইনস্টাইনের ১৯১৬ সালের মার্চ মাসের প্রবন্ধের শেষে তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লেখ আছে : বর্ণালির রক্তিম সরণ, সূর্যের কাছ দিয়ে আসা আলোর বিচ্যুতি এবং বুধগ্রহের অনুসূরের সরল। অনুসূরের সরণ আইনস্টাইনের গণনায় এসেছিল প্রতি শতাব্দীতে ৪৩´´, যা পরীক্ষণলব্ধ ফলের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলে যায়। বর্ণালির রক্তিম সরণ সম্বন্ধে ওই সময়ে কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু হাবল-এর প্রসারণশীল বিশ্বে তার প্রমাণ মিলেছে পরে এবং আলোকের বিচ্যুতি ১৯১৯ সালে এডিংটনের নেতৃত্বে সূর্যগ্রহণ অভিযানে ধরা পড়ার পরেই আইনস্টাইনের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
এখন পর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু সব সময়েই নতুন নতুন পরীক্ষার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। যেমন--- রেবকা ও পাউন্ডের পরীক্ষা। বলা যায় যে, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের টিকে থাকাটা কারো কারো জল্পনা-কল্পনার বিষয়, কারো কারোর সৎ আশা, কিন্তু অনেকেরই গভীর বিশ্বাসের ব্যাপার। আইনস্টাইনের ১৯১৭ সালের একটি প্রবন্ধে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপারে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে আধুনিক বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব। আইনস্টাইন সোয়ার্জশিল্ড সমীকরণের সমাধান (Schwarzschild's equation), রবার্টসন-ওয়াকার মেট্রিক, কৃষ্ণবিবর, শ্বেতবামন, নিউট্রন তারা এসব এবং আরো অনেক কিছু সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ অবদান।
জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদ আইনস্টাইনকে সবসময়ই পীড়া দিয়েছে। এ জন্যই তিনি প্রথমে সুইস এবং পরে আমেরিকান জাতিত্ব গ্রহণ করেছেন, কিন্তু আসলে তিনি কখনও কোনো দেশের ক্ষুদ্র সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ করেননি। রবীন্দ্রনাথের মতো আইনস্টাইন নিজেকে পৃথিবীর নাগরিক মনে করতেন। ইহুদি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান তিনি হতে চাননি, যদিও এক সময়ে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি সক্রিয় সাহায্য করেছেন। সুইস পাসপোর্ট এর মাধ্যমে তিনি রক্ষা পান। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক আগে হিটলারের নাৎসিরা তাকে খুঁজে বেড়িয়েছে এবং বেলজিয়ামের অস্টেন্ডে তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেন না, কিন্তু মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে তাঁর যে তুলনা হয় না একথা সকলেই মানেন। আইনস্টাইন আর নিউটনের মধ্যে সময়ের পার্থক্য দুশো বছর। সুতরাং বলা যায় যে, দুশো বছরে একজন নিউটন অথবা একজন আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানে আবির্ভূত হয়ে পদার্থবিজ্ঞানকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন