বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

পরমাণুর গঠন আবিষ্কারকঃ নীলস বোর এর জীবন

 

পরমাণুর গঠন আবিষ্কারক - নীলস বোর এর জীবনী- Niels Bohr - Life and Works
পরমাণুর গঠন আবিষ্কারক - নীলস বোর এর জীবনী- Niels Bohr - Life and Works

পরমাণুর গঠন আবিষ্কারকঃ নীলস বোর এর জীবন- Niels Bohr - Life and Works

নীলস্ বোরকে (Niels Henrik David Bohr) তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে (১৮৮৫-১৯৬২) আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রতীক, পরমাণু গঠনের প্রধান স্থপতি ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে। আইনস্টাইন ছাড়া অন্য কোনো পদার্থবিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানকে এতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করেননি। নীলস বোরের নাতি এইচ বোরকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তার কাছে এ দু'জনের মধ্যে কাকে বড় মনে হয়। নাতি অবশ্য প্রত্যাশিত উত্তরই দিলেন। কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করায় জানালো, সত্যিকারের শিক্ষক হিসেবে বোরের তুলনা মেলে না।

নীলস্ বোর যে শুধু একজন বৈপ্লবিক তত্ত্বের জনক ছিলেন তাই নয়, তিনি সারাজীবন নতুন নতুন ধারণার উৎস ছিলেন, তীক্ষ্ণ সমালোচক ছিলেন, সাহসী পথপ্রদর্শক ছিলেন এবং একজন অনুপ্রেরণাদানকারী সঙ্গি ছিলেন। তার জন্মতারিখ ১৮৮৫ সালের ৭ অক্টোবর। সুতরাং ১৯০৫ সালে বিশ বছরের যুবক হিসেবে গবেষণার অঙ্গনে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। ওই বছরেই একদিকে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে আইনস্টাইনের ফোটনের ধারণা এবং অন্যদিকে আপেক্ষিক তত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে। নীলসের পিতা ছিলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার খ্যাতনামা অধ্যাপক। পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ানসেন, দার্শনিক হোফডিং এবং ভাষাবিদ থমসেন বোরের গৃহে নিয়মিত অতিথি ছিলেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় পিতা এবং তার বন্ধুদের আলোচনার মনোযোগী শ্রোতা ছিলেন নীলস।

১৯০৩ সালে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন তখন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তা বুঝতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাই বলে তিনি যে বই-এর পোকা ছিলেন তাও নয়। তরুণ বোর ছিলে অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির এবং সাইকেল চড়া, নৌকা চালানো, ফুটবল তাঁর প্রিয় খেলাধুলা ছিল। ছোট ভাই হ্যারল্ড একজন প্রতিভাবাবন ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। হারাল্ড পরবর্তী জীবনে একজন কৃতী গণিতবিদ হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

বোর কোনো সমস্যার শেষ না দেখে ছাড়তেন না। বছরের পর বছর তিনি একই বিষয়ে বারবার ফিরে আসতেন। ২১ বছর বয়সে তিনি প্রথম যে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখলেন, সেটা শেষ করাও তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। গবেষণার একটা অংশ শেষ করার পরেই তার নতুন দিক নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়তেন। শেষে তাঁর পিতা তাঁকে কোপেনহেগেন থেকে দূরে দাদার বাসায় পাঠিয়ে দিলেন এবং সেখানেই প্রবন্ধটি শেষ হয়। এই প্রবন্ধে তিনি পানির পৃষ্ঠতল নিয়ে আলোচনা করে ডেনমার্কের বিজ্ঞান একাডেমির স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন।

১৯১১ সালে নীলস্ বোর ধাতুর ইলেকট্রন তত্ত্বের ওপর গবেষণা করে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি পেলেন। এরপরে তিনি কেমব্রিজে গেলেন ইলেকট্রনের আবিষ্কারক বিখ্যাত অধ্যাপক স্যার জে. জে. থমসনের সঙ্গে গবেষণা করার জন্য। আশা ছিল যে, জে. জে. থমসন তাঁর প্রবন্ধটি পড়বেন এবং তাই যথেষ্ট পরিশ্রম করে ভুল ইংরেজিতে তিনি প্রবন্ধটি ভাষান্তরিতও করলেন। কিন্তু জে. জে, এতই ব্যস্ত যে, বোরের প্রবন্ধটি পড়ার সময় হলো না এবং তা ইংল্যান্ডের কোনো বিজ্ঞান পত্রিকাতেও ছাপানো গেল না।

সুতরাং কয়েক মাস কেমব্রিজে থাকার পর বোর ম্যানচেস্টারে চলে গেলেন রাদারফোর্ডের সঙ্গে কাজ করার জন্য। এখান থেকে ১৯১৩ সালে বোর তাঁর পারমাণবিক গঠনের ওপর যুগান্তকারী প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল অণু এবং পরমাণুর গঠন বিষয়ে। এর কিছুদিন আগেই প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইনের ফোটনের ধারণা এবং রাদারফোর্ডের কেন্দ্রিন পরমাণুর ছবি প্রকাশিত হয়েছে। প্ল্যাঙ্ক শক্তির কোয়ান্টামের ধারণা প্রবর্তন করে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সঠিক সূত্রটি পেয়েছিলেন। আইনস্টাইন এই বিমূর্ত ধারণা। প্রসার করে আলোককণা বা ফোটনের ধারণা সৃষ্টি করলেন এবং তার থেকে আলোক-বিদ্যুৎ প্রতিভাস এবং কঠিন বস্তুর আপেক্ষিত তাপের সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। কিন্তু এছাড়া প্ল্যাঙ্কের ধারণা তেমন আর কোনো ব্যবহার হয়নি। অন্যদিকে রাদারফোর্ড ধাতুর ওপরে আলফা-কণা বিচ্ছুরিত করে পরমাণুর জন্য একটা নকশা প্রস্তাব করলেন। এটা অনেকটা সৌরমণ্ডলের মতো, যেখানে সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলো ঘোরে অর্থাৎ পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে ভারি কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস।

নীলস বোর সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন যে, রাদারফোর্ডের নকশার সঙ্গে প্ল্যাঙ্কের ধারণা একত্রিত না করলে পরমাণুকে স্থায়ী করা যাবে না। রাদারফোর্ড নকশায় কেন্দ্রে রয়েছে ধনাত্মক আধান, কিন্তু বাইরে ঋণাত্মক ইলেকট্রনগুলো কেমনভাবে সাজানো তা কিছুই বলা হয়নি।

কেন্দ্র এর ধনাত্মক আধানের চতুর্দিকে ইলেকট্রনগুলো স্থায়ী সাম্যবস্তায় থাকতে পারে, যদি তারা বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘূর্ণনশীল হয়। কিন্তু চিরায়ত বিদ্যুৎ চৌম্বকতত্ত্ব এ ধরনের ঘূর্ণনশীল ইলেকট্রন বিকিরণের মাধ্যমে শক্তি হারাবে এবং সবশেষে কেন্দ্রিনের মধ্যে গিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

ইলেকট্রন ঘুরতে ঘুরতে শক্তি হারিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে পড়বে। এ ধারণার মূলে রয়েছে আমাদের বিশ্বাস যে, ইলেকট্রনের গতি অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু ইলেকট্রন তার গতি শুধু বিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তন করতে পারে, এ ধারণা নিয়ে এলে আর সমস্যা থাকে না। সুতরাং পরমাণুর স্থায়ীত্বের জন্যই ইলেকট্রনগুলো বিশেষ বিশেষ কক্ষপথে সাধারণত থাকে, এ ধারণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

নীলস্ বোর যখন এই ধারণায় উপনীত হলেন তখন তাঁর বয়স বিশের কোঠায়। তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন যে, রাদারফোর্ডের নকশা একগুচ্ছ ইলেকট্রনের আপাত স্থায়িত্বহীনতা থেকে উদ্ভুত গভীর সমস্যার সম্মুখীন হবে।

আসলে রাদারফোর্ডের নকশার অসুবিধা দূর করার একমাত্র উপায় হলো দৈর্ঘ্যমাত্রাযুক্ত একটা রাশির প্রবর্তন করা। জে. জে. থমসনের পরমাণুর নকশায় এই সমস্যা নেই। কেননা, এখানে ইলেকট্রনগুলো পুডিং-এর মধ্যে কিসমিসের মতো ছড়ানো এবং সেখানে একটা মৌলিক দৈর্ঘ্য সরাসরি পাওয়া যায়, যা আসলে পরমাণুর আকৃতির সমান।"থমসনের নকশায় পরমাণু চুপসিয়ে ছোট হতে পারে না। কারণ, তার আকৃতি স্থায়ী, কিন্তু রাদারফোর্ডের নকশায় এ ধরনের দৈর্ঘ্য আসে না।  

কিন্তু নীলস্ বোর এখানেই দেখালেন সেই দৈব দূরদৃষ্টি, যা অতুলনীয়। সৃজনশীল মনের পরিচয় চিহ্ন।.একটা দৈর্ঘ্যমাত্রার রাশি প্রবর্তন করতে গিয়ে বোর লক্ষ করলেন যে, প্ল্যাঙ্ক যে ধ্রুবকটির সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটি ব্যবহার করেই ইলেকট্রনের ভর এবং আধানের সঙ্গে একত্র করে একটা রাশি তৈরি করা যায়, যার মাত্রা দৈর্ঘ্যের। প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবককে বর্গ করে ইলেকট্রনের ভর এবং আধানের বর্গ দিয়ে ভাগ করলে যে রাশি পাওয়া যায় তার মান হলো ১০-৮ সেন্টিমিটার, অর্থাৎ পরমাণুর আকৃতির সমান। জটিল গণিত ব্যবহার না করেই সহজ যুক্তির ভিত্তিতে এভাবে বোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন।

বোর প্রথমে হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলেন। হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন সবচেয়ে সহজ। কেননা, এখানে শুধু একটি ইলেকট্রন একটি প্রোটনের চতুর্দিকে ঘূর্ণনশীল। প্রোটনের চতুর্দিকে ইলেকট্রনটি অবশ্যই চিরায়ত নিউটনীয় গতিবিদ্যা অনুসারেই ঘোরে। প্রোটন ইলেকট্রনের ওপর যে স্থির-বৈদ্যুতিক কুলম্ব বল প্রয়োগ করে তা ইলেকট্রনের ওপর কেন্দ্রাতিগ বলের সমান। এর ফলে প্রোটনের চতুর্দিকে ইলেকট্রনের কক্ষপথ সূর্যের চতুর্দিকে গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার কক্ষপথের মতোই, যা কেপলার আবিষ্কার করেছিলেন।

কিন্তু এই ছবির অসুবিধা হলো এই যে, গ্রহগুলো আধানহীন, তাই তার থেকে বিকিরণ বের হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। আহিত ঘূর্ণনশীল ইলেকট্রন থেকে বিকিরণ নির্গত হবেই।

বোর এই সংকটজনক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম ধারণা নিয়ে এলেন। তিনি এখন কল্পনা করলেন যে, কেন্দ্রের চারপাশে ইলেকট্রন শুধু বিশেষ বিশেষ বিচ্ছিন্ন কক্ষপথে ঘোরে, সব কক্ষপথে নয় এবং, ওইসব কক্ষপথে যখন ইলেকট্রন থাকে তখন তার থেকে কোনো বিকিরণ নির্গত হয় না। অর্থাৎ এক কথায় চিরায়ত বিদ্যুৎচৌম্বকতত্ত্ব পরমাণুর ক্ষেত্রে বাদ দিয়ে দেয়া হলো। এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। কেননা বিচ্ছিন্ন, বিকিরণহীন কক্ষপথ ব্যবহারের তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া গেল দু'টি।

প্রথমত, বিকিরণহীন বিচ্ছিন্ন কক্ষপথের অস্তিত্বের ফলে স্থায়ী পরমাণুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। পরমাণু এখন সর্বনিম্ন অবস্থায় থাকতে পারে, যখন ইলেকট্রনের কক্ষপথ কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছে।

দ্বিতীয়ত, পরমাণুর অবস্থার পরিবর্তন এখন কেবল বিচ্ছিন্নভাবেই সম্ভব, যা প্রকৃতির কোয়ান্টাম ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পরমাণুতে শক্তির বিকিরণ বা শোষণ ঘটে তখনই, যখন তা এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যায়। এ ধরনের পরিবর্তনে শক্তির কোয়ান্টাম নির্গত বা শোষিত হয়, যার পরিমাণ প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক এবং আলোর কম্পাঙ্কের গুণফল। নিঃসৃত এই শক্তি বর্ণালি হিসেবে দেখা দেয়।

বোর লিখেছেন, বিকিরণ নিঃসৃত করার সময় বস্তুনিচয় এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থাতে পরিবর্তিত হয়। এইসব অবস্থার একটা নাম দেয়ার জন্য এদের আমরা স্থির অবস্থা বলতে পারি, যার সহজ অর্থ হলো যে, এগুলো এক ধরনের অপেক্ষা করার স্থান। এ ধরনের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থা পরিবর্তনের ফলে বর্ণালির বিভিন্ন রেখার অনুষঙ্গী শক্তির নিঃসরণ ঘটে।

সুতরাং বর্ণালির প্রতিটি কম্পাঙ্কের সঙ্গে ইলেকট্রনের দুটো কক্ষপথ জড়িত একটা প্রাথমিক এবং অন্যটা চূড়ান্ত। এ ব্যাপারটাও চিরায়ত বলবিদ্যার মতো নয়। কেননা, সেখানে স্পন্দনের কম্পাঙ্ক সুনির্দিষ্ট, তার জন্য দুটো কক্ষপথ দরকার হয় না।

প্রশ্ন হলো যে, ইলেকট্রন শুধু স্থির অবস্থার কক্ষপথেই থাকবে, অন্য কক্ষপথে থাকবে না কেন? তাদের কি গুণের জন্য প্রকৃতিদত্ত এই বৈশিষ্ট্য? এ প্রশ্নের উত্তর দিতেও নীলস্ বোর অনুপ্রাণিত অনুমানের সাহায্য নিয়েছিলেন। চিরায়ত বলবিদ্যা থেকেই দেখানো যায় যে, ইলেকট্রনের পর্যায়কাল বা কম্পাঙ্ক এবং তার কক্ষপথের আকৃতি আসলে বস্তুকণার কৌণিক ভরবেগ অর্থাৎ তার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ এবং ভরবেগের গুণফলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বোরের অনুমান হলো এই যে, ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ অবিচ্ছিন্ন রাশি নয়, বরং তা প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক। ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ যে কোনো রাশি হতে পারে না, বরং সেই সব কৌণিক ভরবেগই সম্ভব, যা প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবককে পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে পাওয়া যায়। এভাবেই রাদারফোর্ডের নকশার সঙ্গে প্ল্যাঙ্কের ধারণার মিলন ঘটল। বোর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, পদার্থবিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলোর অন্যতম হলো শক্তির কোয়ান্টাম ধারণা এবং পরমাণুর গুণ আলোচনা করতে এই ধারণাকে বিবেচনায় আনতেই হবে।

সহজ বীজগণিত এবং মৌলিক ভৌত ধারণা ব্যবহার করে বোর হাইড্রোজেন পরমাণুর অতি পরিচিত বামার বর্ণালির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি হাইড্রোজেন পরমাণুর অন্য কম্পাঙ্ক যেমন প্যাশেন অথবা লাইম্যান সিরিজও ব্যাখ্যা করা যায়। শুধু তাই নয়, একই তত্ত্ব দিয়ে হিলিয়ামের বর্ণালিও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বোরের এই কাজের পরেই আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, তিনি নিজেও বোরের মতো কিছু ধারণা একসময় করেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করতে সাহস করেননি। তিনি বোরের আবিষ্কারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর অন্যতম বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

নীলস্ বোর ধীরে ধীরে ডেনমার্কের সবচেয়ে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। ১৯২১ সালের ৩ মার্চ তাঁর জন্য ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করা হলো। এখানেই এক সময়ে কাজ করেছেন হল্যান্ডের ক্র্যামারস্ ও ইরেনফেস্ট, সুইডেনের ক্লাইন, ইংল্যান্ডের ডিরাক, জার্মানির হাইসেনবার্গ, ফ্রান্সের ব্রিলোয়া, অস্ট্রিয়ার পাউলি, রাশিয়ার গ্যামো ও ল্যাডাউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মটেলসন ও গ্লাসহাও। ১৯২২ সালে বোরকে পরমাণুর গঠনের ওপর মৌলিক কাজের জন্য নোলে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানে হাইসেনবার্গ এবং বোরের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক পদার্থবিজ্ঞানের একটা মধুরতম অধ্যায়। এ দুজনে মিলেই পদার্থবিজ্ঞানের দার্শনিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি সৃষ্টি করেছেন বলা যায়। অনির্দেশ্যতা তত্ত্বের তাৎপর্য নিয়ে প্রথমে গুরুশিষ্যের মধ্যে মতভেদ হয়েছে; কিন্তু পরে দুজনে সমঝোতায়ও এসেছেন। যে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা এখন প্রায় সব পদার্থবিজ্ঞানী মেনে নিয়েছেন তা বোরের ইনস্টিটিউটে দিনের পর দিন অতিথি পদার্থবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই পূর্ণরূপ নিয়েছে। ভিক্টর ভাইসক এঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তিনি লিখেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে দূর দৃষ্টিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানীদের একত্রিত করাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। ....এ সময়ের কোপেনহেগেনের পরিমণ্ডল, জীবনযাত্রা, মননশীল কর্মকাণ্ড আপনি শুধু কল্পনাই করতে পারেন। ......পদার্থবিজ্ঞানের সুন্দরতম এই যুগে বোর এবং তাঁর সহযোগীরা বিশ্বের মর্মস্থল যেন স্পর্শ করেছিলেন।

কিন্তু এই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা নিয়েই নীলস বোর আইনস্টাইনের সঙ্গে এক বিখ্যাত বিতর্কে জড়িত হয়ে পড়লেন। ওই ব্যাখ্যার মূল কথা হলো এই যে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় যেসব চিরায়ত ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের সঠিকতা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন বস্তুকণার কথা বলি, তখন দেশ ও কালে অবস্থিত শক্তি ও ভরবেগের বিন্দুর কথাই বলি। কিন্তু অন্যদিকে তরঙ্গের ধারণা হলো দেশ ও কালে অনন্ত বিস্তৃত পর্যায়বৃত্ত এক ক্ষেত্র। অথচ কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারণাকে একত্র করে ব্যবহার করা হয়েছে। হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তার সম্পর্ক দিয়ে এই পরস্পরবিরোধী দুটি ধারণার প্রয়োগের সীমবদ্ধতা প্রকাশ করা হয়েছে।

কোয়ান্টামজগতের ঘটনা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে তার মধ্যে পরস্পরবিরোধী রাশি অবশ্যই থাকবে এবং অনিশ্চয়তা সম্পর্কের মাধ্যমেই চিরায়ত ভাষার সীমাবদ্ধতা পরিস্ফুট করা হয়েছে। এই সীমাবদ্ধতাকে পরস্পরবিরোধিতা বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা ধারণার পরিপূরকতা। এই শব্দ দিয়ে বোর বোঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের বিজ্ঞানের দুটো পরিপূরক ধারণা পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তারা উভয়ই অভিজ্ঞতার অবশ্য প্রয়োজনীয় অংশ।

পরিপূরকতার ধারণা পদার্থবিজ্ঞানের ধারণাগত সমস্যার সমাধান করেছে এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু আইনস্টাইন এই কোপেনহেগেন ধারণার মূল ভিত্তি সম্ভাবনার অনুপ্রবেশ কোনোদিনই স্বীকার করে নেননি। বোরের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে আইনস্টাইন একটার পর একটা মৌলিক প্রশ্ন তুললেন এবং তার যুক্তির সমর্থনে এমনকি পরীক্ষণেরও বর্ণনা দিলেন। সহজে আইনস্টাইনের যুক্তি খণ্ডন করা যায় না। কিন্তু বোর একের পর এক যথাযথ উত্তর দিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই যে যুক্তিসঙ্গত তা প্রমাণ করলেন। এমনকি নীলস বোর আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করেই আইনস্টাইনের যুক্তি খণ্ডন করলেন। এটাই বোধ হয় তার সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বোরের ইনস্টিটিউট নাৎসি অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসা পদার্থবিজ্ঞানীদের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়াল। ডেনমার্কের পতনের পর বোর সঙ্গোপনে সুইডেন, ইংল্যান্ড হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। যুক্তরাষ্ট্রে লস এলাম গবেষণাগারে তার ছদ্মনাম ছিল নিকোলাস বেকার।।

যুক্তরাষ্ট্রে আসার ঠিক আগে হান এবং স্ট্রাসম্যানের ইউরেনিয়াম বিশ্লেষণের পরীক্ষণের কথা বোর ফ্রিস এবং মাইটনারের কাছে শুনেছিলেন। নিউইয়র্কে জাহাজ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জন হুইলারকে এই চাঞ্চল্যকর সংবাদ দিলেন। দুজনে তারপর বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া বোঝার জন্য গবেষণা শুরু করলেন। এবং অচিরে প্রমাণ করলেন যে, আসলে ইউরেনিয়াম-২৩৫ বিশ্লিষ্ট হয়, ইউরেনিয়াম-২৩৮ নয়। এটাই পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রথম পদক্ষেপ। নীলস্ বোরই বোধ হয় প্রথম পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি পারমাণবিক বোমার বিপদও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে তিনি বিপদের গুরুত্ব বোঝাতে পারেননি। এটা বুঝতে মানুষের অনেক দিন লেগেছে। তবে আনন্দের কথা এই যে, এখন মানুষ অনেক বেশি সজাগ।

জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো দেশের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকতে পারে না, একথা বোর বিশ্বাস করতেন। এখন থেকে একশ বছর পরে বিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি কোথায় বিকশিত হবে কে জানে? হয়তো জাপানে, হয়তো চীন দেশে। এসব ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মানুষের সব প্রচেষ্টার মূল হওয়া উচিত, একথাও তিনি বুঝতেন। আমাদের সকলের আন্তর্জাতিক হওয়া উচিত, যা বিজ্ঞানে আমরা মোটামুটি ভালোই চর্চা করি। .....সবদেশের মানুষই আসলে একই রকম, পার্থক্যের কারণ ঐতিহ্য এবং ইতিহাস।

বিজ্ঞানের আদর্শ সম্বন্ধেও নীলস্ বোরের ধারণা ছিল স্পষ্ট। এ. এইচ. কম্পটন সম্বন্ধে বোর লিখেছেন, কম্পটন বলতে চান যে, ঈশ্বরের কাছে অনির্দেশ্যতার নীতি বলতে কিছুই নেই। কিন্তু একথা অর্থহীন, পদার্থবিজ্ঞানে আমরা ঈশ্বরের কথা বলি না, বরং আমরা যা জানি তাই নিয়ে আলোচনা করি। ঈশ্বর সম্বন্ধে কথা বলতে হলে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে তা করতে হবে।

নীলস্ বোর বিজ্ঞানে যেমন আনন্দ ও সার্থকতা পেয়েছেন তেমনি তাঁর পরিবারের প্রতিও তার আকর্ষণ ছিল গভীর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আঘাতও পেয়েছেন মর্মান্তিক। ১৯৩৪ সালে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁর সামনেই সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। পুত্রকে রক্ষা করতে বোরের নিজেই ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আত্মত্যাগ ছাড়া মহৎ কিছু অর্জন সম্ভব হয় না। অবশ্যই আত্মত্যাগ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন স্তরের অবস্থার উন্নতি করা যাবে না।

এই মহান বিজ্ঞানী, মহান ডেন, ১৯৬২ সালের ১৬ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। এই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের এক গৌরবময় যুগের সমাপ্তি ঘটে। নিউটনের সঙ্গে, আইনস্টাইনের সঙ্গে একইভাবে সম্মানের সঙ্গে যার নাম চিরকাল উচ্চারিত হবে, তিনি হলেন নীলস্ বোর।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন