শুক্রবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২২

পল ডিরাক এর জীবনী Paul Dirac – Life and Works

পল ডিরাক এর জীবনী  Paul Dirac – Life and Works
পল ডিরাক এর জীবনী  Paul Dirac – Life and Works

 

পল ডিরাক এর জীবনী : Paul Dirac – Life and Works

১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর পদার্থবিজ্ঞানী ডিরাক (Paul Adrien Maurice Dirac) পরলোকগমন করলে আবদুস সালাম বলেছিলেন, পল এড্রিয়েন মরিস ডিরাক ছিলেন এই শতাব্দী বা যেকোনো শতাব্দীর নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯২৫, ১৯২৬ এবং ১৯২৭ এই তিনটি ক্রান্তিকালীন বছরে তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে তিনি প্রথমে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের, তারপর কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের এবং সবশেষে তাঁর বিখ্যাত ইলেকট্রনের সমীকরণ দিয়ে মৌলিক কণার তত্ত্বের ভিত্তিভূমি রচনা করেছিলেন। আইনস্টাইন ছাড়া আর কোনো মানুষ এই শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের প্রগতির ওপর এত অল্প সময়ে এত চূড়ান্ত প্রকৃতির প্রভাব ফেলতে পারেন নি।

সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু ডিরাকের নাম এত পরিচিত নয়। এমনকি তার দেশ ইংল্যান্ডেও খুব কম মানুষই খবর রাখেন যে, ডিরাক চল্লিশ বছর ধরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাশিয়ান প্রফেসর ছিলেন, যে পদে আড়াইশ বছর আগে আইজাক নিউটন কর্মরত ছিলেন। ডিরাক এই পদ পেয়েছিলেন ১৯৩২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, যখন তার বয়স কেবল ৩০। তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৩ সালে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে।

পল ডিরাক ব্রিস্টল শহরে ১৯০২ সালের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জন্মসূত্রে সুইস এবং তার মা ছিলেন জাহাজের একজন ক্যাপ্টেনের চারটি সুন্দরী কন্যার একটি। পিতার কঠোর নিয়ম-কানুনের জন্য তার ছেলেবেলা খুব আরামদায়ক ছিল না। পরবর্তীকালে ডিরাক বলেছিলেন, আমার বাবা নিয়ম করেছিলেন যে, আমি শুধু ফরাসি ভাষায় কথা বলব। তার ধারণা ছিল যে, এভাবেই আমি ফরাসি ভাষাটা ভালোভাবে শিখব। যেহেতু আমি দেখলাম যে, আমি ফরাসি ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না তাই ইংরেজিতে কথা বলার চেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকাই ভালো ছিল। সুতরাং এই সময়ে আমি খুব চুপচাপ থাকতামএটা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।

ডিরাকের এই অল্প কথা বলার অভ্যাস পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছিল। একবার এক আমেরিকান সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে এসে তার মুখ থেকে চার পাঁচটির বেশি শব্দ বের করতে পারেননি। কিন্তু কথা কম বললেও ডিরাকের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য যার হয়েছে, তার পক্ষে তাঁর নিখুঁত উচ্চারণে প্রতিটি শব্দ চয়নের অপূর্ব দক্ষতার কথা কোনোদিনই ভুলতে পারা সম্ভব নয়। ১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মকালে ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে তিনি তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের জীবনের ওপর যে সান্ধ্যকালীন বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার নিরহংকার স্বতঃস্ফূর্ততা, তার সহজ ভাষার ঝংকার, তাঁর অকৃত্রিম আবেদন কোনোদিনই ভোলা যায় না।

স্কুলেই ডিরাকের গাণিতিক প্রতিভা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মাধ্যমিক স্কুলে তিনি তার ক্লাসের অন্য সকলের তুলনায় এত বেশি এগিয়ে ছিলেন যে, তাকে অনেক উচু পর্যায়ের বই পড়তে দেয়া হয়েছিল। ডিরাক নিজে নিজেই অনেক গণিত শিখে ফেলেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন, আমি সবসময়ই আস্তে পড়তাম এবং কবিতা পছন্দ করতাম না। আসলে আমি কখনই কবিতা ভালো বুঝতাম না। আমার সব আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞানের দিকে এবং স্কুলের কাজের বাইরে সব কিছুর ব্যাপারে বাস্তবিকই আমার কোনো জ্ঞান ছিল না।

১৯১৮ সালে স্কুল শেষ করে ডিরাক ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল পড়তে আসেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রকৌশল বেছে নিয়েছিলেন; কেননা তাঁর ওই সময়ের শিক্ষক ডেভিড রবার্টসনের একটা বিরাট গুণ ছিল যে, যে-কোনো গণনার মধ্যে গাণিতিক সৌন্দর্য তিনি ব্যাখ্যা করতে পারতেন।

১৯১৯ সালটিকে ডিরাক একটি উত্তেজনাময় সময় বলে চিহ্নিত করেছেন। ওই বছর আপেক্ষিক তত্ত্ব পৃথিবীর উপর একটি বিশাল বিস্ফোরণের সৃষ্টি করল। হঠাৎ সকলেই আপেক্ষিকতা নিয়ে কথা বলতে লাগল। সংবাদপত্রগুলোতেও এ নিয়ে খবর ভরা থাকত।

ডিরাক নিজেও আপেক্ষিক তত্ত্বের এই উত্তেজনা অনুভব করেছিলেন। এ সময়ে তিনি দর্শন নিয়েও কিছু পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন যে দার্শনিকেরা যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলে তা আসলে অনির্দিষ্ট। আমার মনে হয় না পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে দর্শন কোনো অবদান রাখতে পারবে।

১৯২১ সালে ডিরাক প্রথম শ্রেণী পেয়ে সম্মানের সঙ্গে গ্রাজুয়েট হলেন। কিন্তু তৎকালীন অর্থনৈতিক মন্দার জন্য কোনো চাকরি তিনি পেলেন না। অবশ্যই প্রকৌশলী হিসেবে ডিরাক জীবন কাটাবেন এটা তার ভাগ্যে লেখা ছিল না। এই সময়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বৃত্তিও তিনি পেয়েছিলেন; কিন্তু অর্থের পরিমাণ খুব কম হওয়ায় তখন আর সেখানে তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই দু বছর তিনি ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়েই গণিত বিভাগে পড়াশোনা করেছিলেন। এই সময়কার তাঁর শিক্ষক পিটার ফ্রেজার সম্বন্ধে তিনি বলেছেন যে, তাঁর শিক্ষা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে কেননা তার মধ্যে ছিল গাণিতিক সৌন্দর্যবোধ।

গণিত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর সম্মান ডিগ্রি পাওয়ার ফলে ডিরাকের ১৯২৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রির ছাত্র হওয়া সম্ভব হলে ভাগ্য তাকে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় নিয়ে উপস্থিত হলো।

ডিরাক প্রথমে ভেবেছিলেন যে, আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে তিনি পড়াশোনা করবেন। কিন্তু তার গবেষণার গাইড হলেন আর. এইচ. ফাউলার, যার আকর্ষণ ছিল পরমাণুতত্ত্বে। ওই সময়কার চাঞ্চল্যকর পরমাণু গবেষণায় প্রবিষ্ট হতে ডিরাকের বেশি সময় লাগল না। রাদারফোর্ড, বোর, সমারফেল্ডের পরমাণু সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না। পরমাণুর ধারণাটাই তাঁর কাছে এ যাবৎ কল্পনার ব্যাপার মনে হতো। কিন্তু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা পরমাণুর গঠনের সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করছেন দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।

আসলে এটা ছিল এমন একটা ক্রান্তিলগ্ন, যার তুলনা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে আর নেই। এর আগে ১৯০০ সালে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম ধারণা, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আলোর ফোটনতত্ত্ব এবং ১৯১৩ সালে বোরের পদার্থের গঠনতত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে একটা বিশাল বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সত্যিকারের কোনো তত্ত্ব তখনও সৃষ্টি হয়নি। নানা ধ্যান-ধারণা, অনুমান, নীতি, উপপদ, গণনা পদ্ধতির একটা জগাখিচুড়ি তখন চলছিল, যাকে আজকাল কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে। নীলস্ বোর ছিলেন এই বিশেষ রানাঘরের বিখ্যাত রাঁধুনি।

কিন্তু ১৯২৫ সালে সত্যিকারের পথ প্রদর্শন করলেন ভার্নার হাইজেনবার্গ। ওই বছরের গ্রীষ্মকালে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো এক নতুন ধরনের গণিত। এই গণিতের বৈশিষ্ট্য হলো গুণনের রাশিগুলোর ক্রমের ওপর গুণ ফলের নির্ভরশীলতা। সাধারণ রাশির ক্ষেত্রে দুটি রাশি যেই ক্রমেই গুণ করা হোক না কেন তার গুণ ফল একই থাকে। কিন্তু হাইসেনবার্গের নতুন গণিতে এ কথা আর সত্য নয়এটাকেই বলে অবিনিময়ী মাট্রিক্স গুণন, যা কিছুদিনের মধ্যেই বর্ন, হাইজেনবার্গ এবং জর্ডান বিশদভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আর. এইচ, ফাউলার ডিরাককে হাইসেনবার্গের ঐতিহাসিক প্রবন্ধটির প্রুফকপি পড়তে দিয়েছিলেন। ডিরাক লিখেছিলেন, প্রথমে আমার পক্ষে এটা বোঝা বেশ কষ্টকর ছিল। দুসপ্তাহ চেষ্টার পর আমি হঠাৎ বুঝলাম যে, অবিনিময়ী গুণই হলো হাইসেনবার্গের প্রবর্তিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।

১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মকালে ডিরাক নিচের কথাগুলো বলেছিলেন, ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে আমি এর ওপর গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছিলাম। মনে হয় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমি পয়সঁ ব্রাকেটের ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম। এক রবিবারের দীর্ঘ ভ্রমণের সময়ে আমার মনে হলো যে, বিনিময়কারক হয়তো পয়সঁ ব্রাকেটের তুলনীয় হতে পারে; কিন্তু তখন পয়সঁ ব্রাকেট ঠিক কী তা আমি জানতাম না। আমি এ সম্বন্ধে কিছু পড়েছিলাম; কিন্তু যা পড়েছিলাম তার বেশিরভাগই ভুলে গিয়েছিলাম। এই ধারণাটা যাচাই করতে আমি চেয়েছিলাম; কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। কেননা, বাসায় কোনো বই ছিল না যার মধ্যে পয়সঁ ব্রাকেট আছে, আর সব লাইব্রেরিও তখন বন্ধ। সুতরাং লাইব্রেরিগুলো খুলবে এবং পয়সঁ ব্রাকেট কী তা বাছাই করা যাবে। তখন আমি দেখলাম যে, পয়সঁ ব্রাকেট ঠিক কাজ দেবে, কিন্তু এর জন্য আমাকে একটা অস্থির রাত্রি কাটাতে হয়েছিল।

ডিরাকের এই আবিষ্কার যেমন সুন্দর তেমনি গভীর তাৎপর্যময়। এই বিনিময়ী ব্রাকেট থেকে ডিরাক-হাইসেনবার্গের পথিকৃৎ ফল আবার নির্ধারণ হলে এবং তার ফলে চিরায়ত বলবিদ্যার সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্পর্ক হয়ে গেল।

ডিরাক তাঁর প্রবন্ধটি ১৯২৫ সালের ৭ নভেম্বর প্রকাশের জন্য রয়াল সোসাইটিতে পাঠান এবং ফাউলারের চেষ্টায় তা ডিসেম্বরের ১ তারিখেই প্রকাশিত হয়। এত তাড়াতাড়ি প্রকাশ করার কারণ বর্ন, হাইজেনবার্গ এবং জর্ডান নামে তিন জ্ঞানী ব্যক্তিও একই কাজ করছিলেন। হাইজেনবার্গ স্বীকার করেছেন যে, ডিরাকের এই কাজ অনেক গভীরে গিয়েছিল। আসলে গাণিতিক সৌন্দর্য এবং ভৌত অন্তর্দৃষ্টি ডিরাকের কাজে যেমন দেখা যায় তেমনটি একমাত্র আইনস্টাইনের কাজ ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। পয়র্স ব্রাকেটের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্পর্ক আবিষ্কারকে ডিরাক নিজেও তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করতেন।

১৯২৬ সালের ২৬ আগস্ট ডিরাক আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে সকলকে চমৎকৃত করে দিলেন। এই প্রবন্ধে তিনি অনেকগুলো মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। যার একটি হলো এই যে, তিনি প্রমাণ করলেন পাউলির বর্জন নীতি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অবশ্যম্ভাবী ফল। এই নীতি অনুসারে কোনো দু'টি মৌলিক কণা যেমন দুটি ইলেকট্রন একই সময়ে একই অবস্থায় থাকতে পারে না। ডিরাক দেখালেন যে এর কারণ হলো এই যে, মৌলিক কণার তরঙ্গ অপেক্ষক হয় প্রতিসাম্যের, না হয় বিপরীত প্রতিসাম্যের। প্রথম ক্ষেত্রে বস্তুকণাগুলো বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তারা নতুন এক পরিসংখ্যান মেনে চলে থাকে, এখন বলে ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান, এভাবে প্রকৃতির বস্তুকণাকে দুভাগে ভাগ করা যায়এক ভাগকে বলে বোসন এবং অন্য ভাগকে বলে ফার্মিয়ন। যেমন আলোক কণা হলো বোসন এবং ইলেকট্রন হলো ফার্মিয়ন।।

এরপরে ডিরাক ১৯২৭ সালের ১ মার্চ আর একটি আশ্চর্যজনক প্রবন্ধ প্রকাশ করে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের ভিত্তিভূমি রচনা করলেন, যা বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণার মূল হাতিয়ার। বিদ্যুৎচৌম্বক প্রতিভাস ব্যাখ্যা করতে ম্যাক্সওয়েল অনেক কাল আগে ক্ষেত্রের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন। বিদ্যুতের একটি আধান অন্য একটি আধানের ওপর বল প্রয়োগ করে কীভাবে? বিদ্যুৎ আধান আসলে তার চারদিকের মহাকাশ বা স্পেসকে পরিবর্তিত করে দেয় এবং এই অবিচ্ছিন্ন পরিবর্তনের ধারা এক আধান থেকে অন্য আধানে চলে যায়। অন্যভাবে বলা যায় যে, মহাকাশের প্রতিটি বিন্দু বিদ্যুৎ-চৌম্বকশক্তির আধার, যাকে বলা হয় বিদ্যুৎচৌম্বুক ক্ষেত্র। ডিরাক তাঁর প্রবন্ধে প্রমাণ করেন যে, বিদ্যুৎচৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি আসলে কতকগুলো ভরহীন বস্তুকণার সমাহার, যাদের বলা হয় আলোককণা বা ফোটন। এভাবেই তিনি প্ল্যাঙ্ক এবং আইনস্টাইনের অনুমানকে সুদৃঢ় গাণিতিক ভিত্তির ওপর স্থাপন করলেন এবং এ কাজ যখন তিনি করেন তখন তার বয়স ২৫ বছরেরও নিচে।

কিন্তু এটাই শেষ নয়। ডিরাক যে জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তা হলো তার ইলেকট্রনের সমীকরণ। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে ডিরাক সমীকরণের মতো সার্থক সমীকরণ আর নেই। এই সমীকরণের অবশ্যম্ভাবী ফল এই যে, ইলেকট্রনের একটা নিজস্ব ঘূর্ণন গতি থাকবে, যা অবশ্যই পরবর্তী কালের পরীক্ষিত সত্য। তা ছাড়াও ইলেকট্রন একটি চুম্বকের মতো আচরণ করে এবং তার চৌম্বক ভ্রামক পরীক্ষণ দিয়ে নির্ধারণ করা যায়। ডিরাক সমীকরণ দিয়ে ওই চৌম্বক ভ্রামকও নিখুঁতভাবে পাওয়া যায়।

ডিরাক বলেছেন যে, ১৯২৭ সালে বিখ্যাত সলভে সম্মেলনের সময়ে (যে সম্মেলনে মেঘনাদ সাহা এবং ডি. এম. বসু উপস্থিত ছিলেন যদিও সত্যেন বসুকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল) নীলস বোর তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি কী করছেন? ডিরাক উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি ইলেকট্রনের জন্য একটি আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্মত সমীকরণ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। বোর বলেছিলেন যে, ওইসব সমস্যা তো আগেই অস্কার ক্লাইন সমাধান করেছেন। ডিরাক লিখেছেন যে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সত্যি হলে ক্লাইনের সমীকরণ (যাকে এখন ক্লাইন-গর্ডন সমীকরণ বলে) যে অসুবিধার সম্মুখীন হয় এ সম্বন্ধে অনেকেই সচেতন ছিলেন না। তার ভাষায়, কয়েক মাস ধরে এই সমস্যাটা আমার ছিল এবং তারপর বলা যায় যে, সমাধান হঠাৎ করেই আবির্ভূত হলো........গণিত নিয়ে খেলা করতে করতে এই সমাধান হঠাৎ এসেই গেল।

ডিরাক আবিষ্কার করলেন যে, ক্লাইনের মতো শক্তির বর্গ নিয়ে কাজ না করে শুধু শক্তি নিয়ে কাজ করা দরকার। এর ফল এই যে, এখন ধনাত্মক শক্তি এবং ঋণাত্মক শক্তি দুটোই নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কেননা, শেষেরটা বাদ দেয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ এখন আর নেই।

কিন্তু ঋণাত্মক শক্তির অর্থ কী?

প্রথম দিকে ডিরাক এই প্রশ্নের কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বুঝেছিলেন যে, ঋণাত্মক শক্তির ইলেকট্রন অবস্থা আসলে ধনাত্মক আধানের সঙ্গে জড়িত করা যায়। কিন্তু ভর কী হবে?

তিনি ট্রিয়েস্টের বক্তৃতায় বলেছিলেন, যখন প্রথমে আমার মাথায় এই ধারণা আসে আমার মনে হয়েছিল যে, প্রতিসাম্যের জন্য ভর ইলেকট্রনের ভরের সমানই হবে। কিন্তু সাহস করে এই ধারণা আমি বলতে পারিনি....এটা অবশ্য আমার মোটেই ঠিক হয়নি; এটা কেবল সাহসের অভাবই ছিল।

প্রথম দিকে ডিরাক ঋণাত্মক শক্তির বস্তুকণাকে প্রোটন বলেছিলেন, কেননা প্রোটনের আধান ধনাত্মক। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকেই তিনি সিদ্ধান্তে পোঁছেছিলেন যে, তাঁর সমীকরণের ঋণাত্মক শক্তির সমাধান প্রোটন হতে পারে না। এগুলো আসলে ধনাত্মক আধানের কণা যাদের ভর ইলেকট্রনের ভরের সমান। এভাবেই তিনি পজিট্রনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা দু বছরের মধ্যে অ্যান্ডারসনের পরীক্ষায় আবিষ্কৃত হয়েছিল।

ডিরাক সমীকরণের এই নানাবিধ সাফল্যের জন্য একবার ডিরাক বলেছিলেন যে, সমীকরণটি তার স্রষ্টার তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান। তাঁর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওপর, কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের ওপর এবং ইলেকট্রন সমীকরণের ওপর কাজ প্রত্যেকটির মধ্যে দেখা যায় কালজয়ী প্রতিভার স্বাক্ষর। এছাড়াও তিনি চৌম্বক এক মেরুর ওপরে যে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন তা সাম্প্রতিকতম গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে বিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের গবেষণায়।।

পল ডিরাক যে শুধু নতুন ধারণার স্রষ্টা ছিলেন তাই নয়, তাঁর প্রবন্ধগুলোর গভীরতা এবং স্বচ্ছতা অননুকরণীয় ভাস্বরতায় চির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত প্রিন্সিপল্স অব কোয়ান্টাম মেকানিক্স গ্রন্থটিকে নিউটনের প্রিন্সিপিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের অন্য দুই মহারথী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সালাম এবং ভিগনার। তার কোয়ান্টাম মেকানিক্স গ্রন্থের ভূমিকার যে অনবদ্য প্রকাশভঙ্গি, তা যে কোনো বিখ্যাত সাহিত্যিকের ঈর্ষার বস্তু। এই গ্রন্থ সম্বন্ধে আরেক জন নোবেল বিজয়ী ফাইনম্যান বলেছিলেন যে, তাঁর নিজের কাজ ডিরাকের গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠার বিশদ ব্যাখ্যা মাত্র।

এই স্বল্পভাষী, বিনম্র পদার্থবিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানে যে অবদান রেখে গিয়েছেন তার তুলনা শুধু আইনস্টাইনের সঙ্গেই করা চলে। জীবনের শেষদিকে তিনি কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের অসম্পূর্ণতা নিয়ে গবেষণারত ছিলেন। তাঁর শেষ প্রবন্ধটি তাঁর আশীতিতম জন্মদিবস উপলক্ষে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সারল্যের সঙ্গে লিখেছেন, আমি তত্ত্বে একটি হ্যামিল্টনীয় অপেক্ষক নিয়ে আসার গবেষণায় বহু বছর কাটিয়েছি, কিন্তু এখনও তা পাইনি। যতদিন পর্যন্ত সম্ভব আমি এর ওপর কাজ করে যাব এবং আশা করব যে, অন্যরাও এই ধরনের কাজ করবেন।

আইনস্টাইনের মতো ডিরাক জীবনের শেষ বছরগুলো শান্তভাবে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে তাঁর অন্তরের ডাকে যে কাজ করবেন ঠিক করেছেন, তা একলাই করে গিয়েছেন। অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে নেই---সে সম্বন্ধে কোনো চিন্তাই তাঁর ছিল না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন