বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

ভার্নার হাইজেনবার্গ : কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্রষ্টা - Werner Heisenberg - Pioneer of Quantum Mechanics

ভার্নার হাইজেনবার্গ  কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্রষ্টা - Werner Karl Heisenberg - Pioneer of Quantum Mechanics
ভার্নার হাইজেনবার্গ  কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্রষ্টা - Werner Karl Heisenberg - Pioneer of Quantum Mechanics

ভার্নার হাইজেনবার্গ : কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্রষ্টা - Werner Karl Heisenberg - Pioneer of Quantum Mechanics

ভার্নার হাইজেনবার্গ নিঃসন্দেহে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে চিরকাল ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকবেন। তাঁর অনির্দেশ্যতার নীতি জনমনে যেমন কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে, একমাত্র আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব ছাড়া অন্য কিছুই বোধহয় এতটা আলোড়নের সৃষ্টি করেনি।

ভার্নার হাইজেনবার্গ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর জার্মানির উরযবুর্গ (Würzburg) শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি মিউনিখে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ছাত্রাবস্থা কেটেছে মিউনিখ এবং গটিনজেনে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আর্নল্ড সমারফেল্ডের (Arnold Sommerfeld) অধীনে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কোপেনহেগেনে নীলস বোরের সঙ্গে দুই বছর কাজ করেন এবং ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে লিপজিগ (Leipzig) বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিযুক্তি লাভ করেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওপর মৌলিক আবিষ্কারের জন্য ১৯৩২ সালের নোবেল পুরস্কার তাঁকে দেয়া হয় পরের বছর, যখন তার বয়স মাত্র ত্রিশ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি বার্লিনের বিখ্যাত কাইজার ভিলহেল্ম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ছিলেন এবং যুদ্ধের পরে ১৯৪৬ সালে তাকে নবগঠিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর নিয়োগ করা হয়, যেখান থেকে তিনি ১৯৭১ সালে অবসরণ গ্রহণ করেন।

কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় হাইজেনবার্গ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মসাধনায়। আণবিক এবং পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, কেন্দ্রিন এবং মৌলিক কণাবিজ্ঞান সর্বত্রই তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আবিষ্কারের সঙ্গেই তার নাম সবচেয়ে বেশি জড়িত। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের জন্য একটা তুলনাহীন ঘটনা; মানুষের চিন্তাজগতে এ ধরনের সার্বিক বিপ্লবের উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ থেকে ২২ জুন নীলস বোর গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভিড হিলবার্টের আমন্ত্রণে সাতটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতামালাকে বলা হতো বোর উৎসব। বোর তার বক্তৃতায় পারমাণবিক গঠন সম্বন্ধে তার নিজের তত্ত্বের বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন। পরমাণুর কেন্দ্রিনের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের কক্ষপথ কেমন হবে এটাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়।

বোরের বক্তৃতা শুনতে গটিনজেনের পদার্থবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ সকলেই এসেছিলেন। এমনকি মিউনিখ থেকে সমারফেল্ড তাঁর দুজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র নিয়ে এসেছিলেন। এরা হলেন ওলফগ্যাং পাউলি (Wolfgang Ernst Pauli) এবং ভার্নার হাইজেনবার্গ। বোরের বক্তৃতা দুজনকেই গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং বলা যায় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রপাত ওই বক্তৃতার দিনগুলি থেকেই। বোর তাঁর বক্তৃতার এক পর্যায়ে স্টার্ক প্রক্রিয়ার ওপরে ক্রেমারস্-এর গবেষণার কথা উল্লেখ করেন যার ভিত্তি ছিল বোরের অতিপ্রিয় করেসপন্ডেন্স নীতি। তরুণ হাইজেনবার্গ এই কাজের ওপরেই এক নীতিগত আপত্তি তুললেন, যার উত্তর বোরের পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল।। বোর তরুণ হাইসেনবার্গের গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।

এর আগে হাইজেনবার্গ মিউনিখের ম্যাক্স মিলিয়ান জিমন্যাসিয়ামে ভাষা এবং গণিত শিখেছিলেন। সতরো বছর বয়সে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি কিছুদিন সামরিক বাহিনীতেও কাজ করেছিলেন। এ সময়ে তিনি প্রহরীর দায়িত্ব পালন করার ফাঁকে ফাঁকে প্লেটোর টিমেউস গ্রন্থটি পড়তেন এবং বস্তুর গঠন সম্বন্ধে প্লেটোর ধারণা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল তা তিনি লিখেছিলেন। ১৯২০ সালে হাইজেনবার্গ মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্নল্ড সমারফেল্ডের অধীনে গবেষণা করতে এলে তাকে প্রথমে পরমাণুর গঠন নিয়ে কাজ করতে দেয়া হয়। এ সময়ে হাইজেনবার্গ বোরের তত্ত্ব ব্যবহার করে বিষম জিমান প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনি দেখালেন যে, এই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে অর্ধপূর্ণ কোয়ান্টাম সংখ্যা ব্যবহার করতে হয়। তার শিক্ষক সমারফেল্ড ঠিক অধপূর্ণ সংখ্যা পছন্দ করতে পারলেন না, কিন্তু তার ছাত্রের মেধা সম্বন্ধে তাঁর কোনো সন্দেহই রইল না।

হাইসেনবার্গের ডক্টরেট গবেষণার জন্য সমারফেল্ড পানি-গতিবিদ্যার একটি সমস্যা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সমস্যাটি হলো তরল পদার্থ রৈখিক প্রবাহ থেকে বিক্ষুব্ধ প্রবাহে কখন পর্যবসিত হয়। তিনি এই সমস্যা সমাধানের জন্য নিজস্ব আসন্নমান পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রবাহ অস্থিতিশীল হয় যখন রেনল্ডস্ সংখ্যা ১০০০-এর বেশি হয়। ১৯২৩ সালের তাঁর এই কাজকে ১৯৫২ সালে এল. এইচ. টমাস কম্পিউটার ব্যবহার করে সঠিক বলে প্রমাণ করেন। হাইসেনবার্গের পিএইচ. ডি. ডিগ্রির মৌখিক পরীক্ষার অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন ভিলহেলম ভিন, যার নাম অনুসারে ভিনের বিকিরণ সূত্র - বিজ্ঞানে অতি পরিচিতি। ভিন তাঁকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিশ্লেষণী ক্ষমতার ওপর প্রশ্ন করলেন, যার উত্তর তার জানা ছিল না। ক্রদ্ধ ভিন তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমারফেল্ডের জন্যই তা হয়নি। মজার ব্যাপার এই যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিশ্লেষণী ক্ষমতা বহুদিন পরে হাইসেবার্গের বিখ্যাত অনির্দেশ্যতা তত্ত্বের প্রসঙ্গে ফিরে এসেছিল।  

১৯২৩ সালের জুলাই মাসে পরীক্ষার পর অত্যন্ত হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় হাইজেনবার্গ গটিনজেনে ম্যাক্স বর্নের (Max Born) কাছে এসে হাজির হলেন। ম্যাক্স বর্ন লিখেছেন, দেখতে তাঁকে একজন সাদাসিধে কৃষকের ছেলে বলে মনে হয়েছিলছোট ছোট ধূসর চুল, পরিষ্কার উজ্জ্বল চোখ এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সহকারীর দায়িত্ব তিনি পাউলির চেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং আমার জন্য তিনি বড় রকমের সাহায্যকারী হয়ে উঠলেন। তাঁর অবিশ্বাস্য মানসিক ক্ষিপ্রতা এবং বুঝবার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে বিশেষ কোনো পরিশ্রম ছাড়াই বিপুল পরিমাণ কাজ করতে সক্ষম করত।

ম্যাক্স বর্নের সঙ্গে হাইজেনবার্গ হিলিয়াম পরমাণুর ওপরে গবেষণা করেছিলেন। নীলস্ বোরের কোয়ান্টাম শর্ত ব্যবহার করে দেখা গেল যে, প্যারাহিলিয়ামের আয়নীকরণ শক্তি ঠিকমতো পাওয়া যায় না; কিন্তু অর্ধপূর্ণ কোয়ান্টাম সংঘ্যা নিলে পরীক্ষণের ফলের সঙ্গে তত্ত্বের ফল মিলে যায়। আবার সেই অর্ধপূর্ণ কোয়ান্টাম সংখ্যা!

সুতরাং দুবছর আগে বোর উৎসবের সময়ে সকলের যে খুশির ভাব ছিল। তা আর রইল না। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে এমনকি নীলস্ বোর পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে, আসলে পরমাণুর তত্ত্ব বলতে তখন কিছুই নেই। ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে হাইজেনবার্গ গটিনজেনে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং এই সময়ে তিনি হাইড্রোজেন বর্ণালির তীব্রতা গণনা করার চেষ্টা করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝলেন যে, প্রচলিত গণিত দিয়ে এ কাজ করা অসম্ভব।

আসলে পরমাণুর ইলেকট্রন যখন এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যায়, তখনই বিকিরণের উদ্ভব হয়। সুতরাং এটা প্রায় অবধারিত যে, বিকিরণ সম্ভাবনার মধ্যে প্রাথমিক এবং চূড়ান্ত উভয় অবস্থার নির্দেশক কোয়ান্টাম সংখ্যা থাকবে। এর ফলে যে কোনো দুটি ভৌত রাশির গুণন আর আগের মতো সহজে করা যাবে না। প্রচলিত গণিতে xy সব সময়েই yx-এর সমান, কিন্তু পরমাণুর ক্ষেত্রে এ দাবি আর করা যায় না। কেননা x এবং y এখন ভিন্ন ভিন্ন কোয়ান্টাম সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল।

পদার্থবিজ্ঞানে এ ধরনের গণিত আগে আর কখনো ব্যবহৃত হয়নি এবং ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে না পারলেও হাইজেনবার্গ একটা উদাহরণ খুঁজতে শুরু করলেন, যেখানে তার এই নতুন ধারণা তিনি প্রয়োগ করতে পারবেন। তিনি বিষম ছন্দিত স্পন্দকের ওপর তাঁর নতুন গণিত প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখলেন যে, অবস্থা পরিবর্তনের রাশিটি গতিসমীকরণ থেকে ঠিক নির্ধারণ করা যায় না।

১৯২৫ সালের জুন মাসে তিনি এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছিলেন এবং এ সময়ে অসুস্থ হয়ে তিনি উত্তর সাগরের হেলগোল্যান্ড দ্বীপে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য চলে গিয়েছিলেন। এই দ্বীপে বসে তিনি শুধু তার স্বাস্থ্য উদ্ধারই করলেন না, পারমাণবিক বিজ্ঞানে নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন। পল ডিরাক (Paul Adrien Maurice Dirac) বলেছেন, আমরা দু জনেই তখন তরুণ ছিলাম এবং একই সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলাম। তিনি সার্থক হয়েছিলেন, কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম।

এই দ্বীপে হাইজেনবার্গ দুটি সমস্যার সমাধান করেছিলেন। প্রথমত বোরের কোয়ান্টাম শর্ত নতুন গণিতে কীভাবে লিখতে হবে, তা তিনি আবিষ্কার করলেন এবং দ্বিতীয়ত, নতুন পদ্ধতিতে শক্তি সংরক্ষণের নীতি যে বজায় থাকে, তা প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন। তিনি লিখেছেন, রাত প্রায় তিনটার সময়ে আমার গণনা শেষ হলো। শক্তির নীতিটি সর্বত্র বজায় রইল এবং আমার গণনার মধ্য দিয়ে যে ধরনের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উদ্ভব হবে তার গাণিতিক সামঞ্জস্য সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। প্রথম দিকে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যে, পারমাণবিক ঘটনার পৃষ্ঠতলের মধ্য দিয়ে আমি আশ্চর্যজনকভাবে সুন্দর এক অভ্যন্তরের দিকে চেয়ে রয়েছি এবং এই চিন্তায় আমার প্রায় মাথা ঘুরে গেল যে, এখন আমাকে এই গাণিতিক গঠনের সম্পদ আবিষ্কার করতে হবে, যা প্রকৃতি এত দয়া করে আমার সামনে এনে দিয়েছে। উত্তেজনায় আমার ঘুম হলো না এবং তাই যখন নতুন দিনের প্রভাত এল, আমি তখন দ্বীপের দক্ষিণতম প্রান্তে গেলাম, সেখানে সমুদ্রের দিকে বের হওয়া একটা শিলাখণ্ডের ওপরে আরোহন করার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। আজ উঠতে আমার খুব বেশি কষ্ট হলো না এবং আমি সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

এটাই কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার তথা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সূর্যোদয়। জুলাই মাসের শেষের দিকে হাইজেনবার্গ তাঁর প্রবন্ধটি ম্যাক্স বর্নকে দিলেন এবং ম্যাক্স বর্ন লিখেছেন যে, তিনি হাইসেনবার্গের প্রতীক গুণন নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলেন এবং এর মধ্যে এতই নিমগ্ন হয়ে গেলেন যে, তিনি সারাদিন চিন্তা করে রাত্রেও ঘুমাতে পারলেন না। ভোর বেলায় হঠাৎ আমি আলো দেখতে পেলাম যে, হাইসেনবার্গের প্রতীকী গুণন আসলে ম্যাট্রিক্স ক্যালকুলাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

হাইসেনবার্গের কোয়ান্টাম শর্তের সমীকরণটি ম্যাক্স বর্ন ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে প্রকাশ করে দিলেন এবং এভাবেই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের সৃষ্টি হলো। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই হাইজেনবার্গ, বর্ন এবং জর্ডান (Ernst Pascual Jordan) এই তিন জ্ঞানী ব্যক্তি একটি বড় প্রবন্ধে ম্যাট্রিক্স কোয়ান্টাম গতিবিজ্ঞানের মূল কথাগুলো তুলে ধরলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই ডিরাকের হ্যামিল্টনীয় পদ্ধতির ওপর এবং শ্রোডিঞ্জারের তরঙ্গ বিজ্ঞানের ওপর প্রবন্ধ দুটি প্রকাশিত হয়। কোয়ান্টাম গতিবিজ্ঞান হাইজেনবার্গ, ডিরাক এবং শ্রোডিঞ্জার প্রাই একই সঙ্গে সৃষ্টি করার গৌরব অর্জন করেন।  

১৯২৬ সালের গ্রীষ্মকালে শ্রোডিঞ্জার মিউনিখে একটি বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। তাঁর বক্তৃতা সকলেই খুব পছন্দ করলেন। কেননা, এ সময়ে তিনি তার বস্তু-তরঙ্গকে বাস্তব-তরঙ্গ বলে মনে করতেন। এভাবেই তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বোরের কোয়ান্টাম ঝাপ (Quantum jump) ইত্যাদি রহস্যময় কাণ্ড বাদ দিতে পারবেন। শ্রোতারা এতে খুবই খুশি হলেন। কিন্তু হাইজেনবার্গ উঠে বললেন যে, শ্রোডিঞ্জারের এই ধারণা সত্যি হলে প্ল্যাঙ্কের সূত্র আর বোঝা যাবে না। কেননা, এই সূত্রের শক্তির বিচ্ছিন্ন পরিবর্তনের কথাই বলা হয়। ভিলহেলম ভিন খুব চটে গিয়ে বললেন, যুবক, কোয়ান্টাম ঝাপ ইত্যাদি যে এখন ভুলে যেতে হবে এটা তোমার জন্য খুব দুঃখের ব্যাপার আমরা জানি, কিন্তু দেখবে শ্রোডিঞ্জার সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন।

কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। সারাটা গ্রীষ্ম বোর এবং হাইজেনবার্গ কোপেনহেগেনে বসে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করলেন। পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের কক্ষপথ বলে কিছু নেই তা না হয় বোঝা গেল! কিন্তু মেঘকক্ষে কী হয়? এই মেঘকক্ষে আমরা যে ইলেকট্রনের পথরেখা দেখি--- সেটা কি ইলেকট্রনের কক্ষপথ, না অন্য কিছু।

১৯২৬-এর সারা গ্রীষ্মকাল বোর এবং হাইজেনবার্গ এই সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। বোরের চিন্তাধারা ছিল তরঙ্গ এবং বস্তুকণার দ্বৈত প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা খোজা। হাইজেনবার্গ গাণিতিক প্রকাশের ওপর বেশি নজর দিয়ে কোয়ান্টাম গণিতের সুসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন। কিছুদিন পরে বোর নরওয়ে চলে গেলেন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার জন্য। কিছুদিন আগে বার্লিনে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি একটি মন্তব্য করেছিলেন, কোপেনহেগেনে বসে হাইসেনবার্গের হঠাৎ সে কথা মনে পড়ে গেল। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, তত্ত্বই ঠিক করে দেয় পরীক্ষণে কী দেখা যাবে। তিনি বলেছিলেন, কোনো একটা জিনিস দেখা যাবে কিনা তা কোন তত্ত্ব ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে। পরীক্ষণের অর্থ হলো এই যে, আমরা প্রতিভাস এবং তা বাস্তবায়নের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করি। পরমাণুর মধ্যে একটা কিছু ঘটে, যার ফলে আলো নির্গত হয় এবং আমাদের আলোকচিত্রে তা ধরা পড়ে। এই সমগ্র ঘটনা পরম্পরার মধ্যে পরীক্ষণ দিয়ে কী পাওয়া যাবে তা নির্ভর করবে আমাদের তত্ত্ব কী বলে তার ওপর। সুতরাং প্রশ্ন এটা নয় যে, মেঘকক্ষে দেখা ইলেকট্রনের কক্ষপথ বাস্তবিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় আছে কিনা। প্রশ্ন হলো এই যে, প্রকৃতিতে অর্থাৎ মেঘকক্ষে এমন ঘটনাই সবসময়ে ঘটবে, যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গণিত দিয়ে বর্ণনা করা যায়। সুতরাং হাইজেনবার্গ বললেন যে, এই নতুন গণিত দিয়ে কী বর্ণনা করা যায় তাই আসলে বিবেচ্য। ডিরাক ও জর্ডানের তত্ত্ব ব্যবহার করে তিনি দেখালেন যে, ইলেকট্রনের সঠিক অবস্থান এবং সঠিক ভরকে একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে মাপা যায়

এভাবেই তিনি তাঁর বিখ্যাত অনির্দেশ্যতা তত্ত্বে উপনীত হয়েছিলেন। এভাবেই হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাত্ত্বিক ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিলেন।

আইনস্টাইন এই ব্যাখ্যা স্বীকার করেননি সারা জীবন। ১৯২৭ সালের বিখ্যাত সভে সম্মেলনে আইনস্টাইন এবং বোরের মধ্যে এক দীর্ঘ আলোচনা হয়। হাইজেনবার্গ লিখেছেন, আমরা, একই হোটেলে থাকতাম। সকালে প্রাতঃরাশের সময়ে আইনস্টাইন এসে বোরকে একটা নতুন মানসিক পরীক্ষার কথা বলতেন, যা দিয়ে অনির্দেশ্যতার সম্পর্ক এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের আমাদের ব্যাখ্যা বাতিল করা যায়। ফলে বোর, পাউলি এবং আমি খুব উদ্বিগ্ন হতাম, সভাস্থলে বোর এবং আইনস্টাইনের পেছনে পেছনে যেতাম এবং সারাদিন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতাম। কিন্তু রাত্রেই নৈশভোজের আগেই বোর সমস্যাটি সমাধান করে ফেলতেন এবং আইনস্টাইনকে সমাধানটি দিলে আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম। আইনস্টাইন একটু দুঃখ পেতেন এবং বলতেন, তিনি এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন। পরের দিন সকালে তিনি আবার একটা নতুন মানসিক পরীক্ষার অবতারণা করতেন এবং আবার আমাদের তা আলোচনা করতে হতো। এভাবে বেশ কয়েকদিন গেল এবং সম্মেলনের শেষে কোপেনহেগেনের পদার্থবিজ্ঞানীদের এই ধারণা হলো যে, তারা যুদ্ধে জিতেছেন। আইনস্টাইন আর কোনো যথার্থ আপত্তি তুলতে পারলেন না। আমার মনে হয় বোরের সবচেয়ে সুন্দর যুক্তি ছিল সেটাই, যখন তিনি সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করে আইনস্টাইনের আপত্তি খণ্ডন করেছিলেন। আইনস্টাইন একটা পরীক্ষণের কথা বলেছিলেন, যেখানে একটা যন্ত্রের ওজন অভিকর্ষ দিয়ে নিরূপিত হয় এবং তাই বোর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করে দেখালেন যে, অনির্দেশ্যতার সম্পর্কই সঠিক।  

এই অনির্দেশ্যতা তত্ত্ব (Heisenberg's uncertainty principle) নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। একশ্রেণীর বিজ্ঞানী বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের অছিলায় এই অনির্দেশ্যতা তত্ত্বের সম্পূর্ণ মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছেন। এভাবে তারা একটি গাণিতিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক আবিষ্কারকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে হেয় করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তাদের মনগড়া ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে না, সে কথা তারা ভুলে যান।

হাইজেনবার্গ শুধু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কার করেছিলেন তাই নয়। তিনি কেন্দ্রিন পদার্থবিজ্ঞানেও মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। ক্ষেত্রতত্ত্বেও তার অবদান অপরিসীম। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি মৌলিক কণার একটি একীভূত সমীকরণ আবিষ্কার করার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিলেন। কিন্তু এ কাজে তিনি সার্থকতা লাভ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে তার জীবনদর্শন তিনি একটি গল্পের মাধ্যমে বলে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ডিরাক অনেক সময় বলতেনআমার মনে হয়েছে একটু সমালোচনার মনোভাব নিয়েই যে, তার ধারণা আমরা এক একটা সমস্যা এক একবারে সমাধান করতে পারি। তাঁর কথা হয়তো ঠিক, কিন্তু এভাবে আমি সমস্যা দেখতাম না। আমার মনে হতো যা নীলস বোর বলেছিলেন, আপনার বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে সঠিক বক্তব্যের বিপরীতটা অবশ্যই ভুল বক্তব্য। কিন্তু আপনি যদি একটা গভীর সত্যে উপনীত হন তাহলে গভীর সত্যের বিপরীতেও একটা গভীর সত্য থাকতে পারে। সুতরাং আমার মনে হয় যে, যে-কোনো সময়ে শুধু, একটা সমস্যাই সমাধান করা যায় এটাও যেমন গভীর সত্য তেমনি যে-কোনো সময়ে শুধু একটা সমস্যাই সমাধান করা যায় না, অনেকগুলো সমস্যার একই সঙ্গে সমাধান করতে হয়, এ বক্তব্যও একইভাবে সত্য।

হাইজেনবার্গ পদার্থবিজ্ঞানের এক ক্রান্তিলগ্নে স্তুপীকৃত সমস্যার অতুলনীয় সমাধান যেমনভাবে দিয়েছিলেন তার জন্য মানুষের ইতিহাসে তার নাম সবসময়ে প্রথম সারিতেই লেখা থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন