রবিবার, ১৫ মে, ২০২২

গাঁজা, চরস, ভাং, সিদ্ধি – বৃক্ষের কথা – হুমায়ূন আহমেদ – Gaja – Charas – Bhang – Siddhi – Brikkher Kotha - Humayun Ahmed

গাঁজা, চরস, ভাং, সিদ্ধি – বৃক্ষের কথা – হুমায়ূন আহমেদ – Gaja – Charas – Bhang – Siddhi – Brikkher Kotha - Humayun Ahmed

গাঁজা, চরস, ভাং, সিদ্ধিবৃক্ষের কথাহুমায়ূন আহমেদ – Gaja – Charas – Bhang – Siddhi – Brikkher Kotha - Humayun Ahmed

গাঁজা, চরস, ভাং, সিদ্ধিবৃক্ষের কথাহুমায়ূন আহমেদ – Gaja – Charas – Bhang – Siddhi – Brikkher Kotha - Humayun Ahmed

গাঁজা

পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক নুহাশ পল্লীতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি নুহাশ পল্লীর ওষধি বাগান দেখে এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, গাজার গাছ আছে কি-না?

আমার মন খারাপ হলো এই ভেবে যে এত গাছ জোগাড় করেছি, গাজার গাছ জোগাড় করতে পারি নি! এর পর যাকেই পাই তাকেই বলি, একটা গাজার গাছ জোগাড় করে দিতে পারেন? যাকে বলা হয় তিনি কেমন করে যেন তাকান। তাঁকে দোষ দিতে পারি নাকেমন কেমন করে তাকাবারই কথা। গাজা নিয়ে রয়েছে বিখ্যাত লোকজ গান

গাজার নৌকা শূন্যের ভরে যায়

অর্থ গঞ্জিকাসেবীর নৌকা পানিতে চলে না, শূন্যে উড়াল দিয়ে চলে।

শিবের প্রিয় বস্তু গাঁজা এবং ভাং। বর্তমানের অনেক তরুণ-তরুণী শিবের পথ ধরেছেন, গাঁজা খাচ্ছেন। তবে তাদের আদর্শ শিব নাপশ্চিমা দেশগুলির তরুণ-তরুণী যেহেতু তারা Grass খাচ্ছে, কাজেই আমাদেরও খেতে হবে।

বছর পনেরো আগে আমি সুসং দুর্গাপুর গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা মেলাবার বেশ অনেকক্ষণ পর শাখের আওয়াজ হতে লাগল। থেমে থেমে শাঁখের আওয়াজ আমাকে বলা হলো, গাঁজা খাওয়ার জন্যে ডাকছে। গঞ্জিকাসেবীরা এই আওয়াজ শুনে একত্রিত হবেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আনন্দময় ভুবনে (!) প্রবেশ। করবেন। কাছে গিয়ে দৃশ্যটা দেখার শখ ছিল। আমাকে বলা হলো, কাছে গেলেই খেতে হবে

গাঁজা গাছটির বোটানিক্যাল নাম Canabis sativa Linn. গোত্র Urticaceae.

শুভ সংবাদ হচ্ছে, এই গোত্রের আর কোনো গাছেরই মাদক গুণ নেই।

গাঁজা গাছের স্ত্রী-পুরুষ আছে। দুই ধরনের গাছেই ফুল হয়। তবে শুধু স্ত্রী গাছই গাঁজা, ভাং এবং চরস দেয়। পুরুষ গাছের মাদক ক্ষমতা নেই। তাই ধিক জানাই পুরুষ গাঁজা বৃক্ষকে।

স্ত্রী গাছের শুকানো পাতাকে বলে সিদ্ধি বা ভাং। কালীপূজায় ভাং-এর শরবত অতি আবশ্যকীয় বস্তু। ভাং-এর শরবত কী করে বানাতে হয় সেই রেসিপি জোগাড় করেছি। সংগত কারণেই দিচ্ছি না এই শরবত ভয়ঙ্কর হেলুসিনেটিং ড্রাগ ট্রাকের পেছনে যেমন লেখা থাকে ১০১ হাত দূরে থাকুন, ভাং-এর শরবত থেকে ১০১ মাইল দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।

স্ত্রী গাজা গাছের পুষ্পমঞ্জুরী থেকে তৈরি হয় গাঁজা। খুব কঠিন প্রস্তুতিপর্ব না রোদে শুকিয়ে নিলেই হলো। স্ত্রী গাছের কাণ্ড, পাতা এবং ফুল থেকে আঠালো যে নির্যাস বের হয় তা জমিয়ে তৈরি হয় চরস। শুনেছি চরস খেতে হয় ময়লা দুর্গন্ধময় কাথা বা কম্বল গায়ে জড়িয়ে। কাঁথা কম্বল যত নোংরা হবে, নেশা না কি ততই জমবে।

 

গাঁজা রসায়ন

গাঁজা গাছের ফুল, ফল, পাতা এবং এর গা থেকে বের হওয়া নির্যাসে আছে সত্তুরেরও বেশি ক্যানাবিনয়েডস। এদের মধ্যে প্রধান ক্যানাবিনল, ক্যানবিডিওল, ক্যানাবিনিন। এছাড়াও আছে নানান ধরনের Alhaloids (নাইট্রজেন ঘটিত যৌগ) এবং কোলিন ট্রাইনেলিন। এইসব জটিল যৌগের কারণেই গাঁজা, ভাং এবং চরসসেবীদের ভেতর তৈরি হয় অবসাদ, নেশা এবং বিভ্রম। দীর্ঘ ব্যবহারে ব্রেইনের বারোটা বেজে যায়। নানান ধরনের স্নায়ুবিক রোগ দেখা দেয়। যে বস্তু শিব এবং নন্দি ভৃঙ্গি হজম করে, সেই বস্তু আমরা হজম করব কীভাবে?

গাঁজা গাছের ভেষজ দিক

এখন দেখা যাক গাঁজা গাছের ভেষজ দিক। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে চীন সম্রাট সেন নুং গাজা গাছের ওষধি গুণ প্রথম আবিষ্কার করেন (সূত্র Internet, নওয়াজেশ আহমেদ, বাংলার কনফুল) প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এর ওষধি গুণ নিয়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। শিবকালী ভট্টাচার্য লিখছেন— “চরসের চিকিৎসা স্থানের প্রথম অধ্যায়ে এবং সুশ্রুতের চিকিৎসাস্থানের ২৯ অধ্যায়ে সোমবন্ধুরীর উল্লেখ থাকলেও এটা যে সিদ্ধি বা ভাং এটাকে উপস্থাপিত করা যায় না।

তথ্যকথা বাদ থাকুক। আমরা বরং এই নিষিদ্ধ গাছের ভেষজ প্রয়োগ দেখি।

গাঁজার ভেষজগুণ কোনো শ্রুতিতে নেই, তবে ভারতবর্ষে এর ভেষজ ব্যবহার অনেকদিন থেকেই আছে। গাঁজা হচ্ছে ত্রিমূর্তি ভেষজ। সত্ত্ব, রজঃ এবং তমোর মিলিত রূপ।

পাঠক যদি প্রশ্ন করে বসেন সত্ত্ব, রজঃ, তমোর ব্যাখ্যা কী? আমি নাচার। ব্যাখ্যা করতে পারব না। আপনাদের যেতে হবে বেদাচার্যের কাছে।

 

গাজার ঔষধি ব্যবহার

-অর্শরোগের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হলে দুধের সঙ্গে বেটে প্রলেপ দিতে হবে।

-প্রাচীনকালে গনোরিয়াতে (যৌনরোগ) গাঁজার ব্যবহার হতো।

-দুধের সঙ্গে বেটে ক্ষতে লাগানো হতো।

-অতি আধুনিক কালে ইউরোপের হাসপাতালে ক্যান্সারের প্রচণ্ড ব্যথা কমানোয় গাঁজার ধোয়া পান করতে দেয়া হয়।

 

সিদ্ধির ঔষধি ব্যবহার

গাজার পাতারই আরেক নাম সিদ্ধি কিংবা ভাং। মহাপুরুষরা সিদ্ধি লাভের জন্যে এই বস্তু ব্যবহার করতেন। মহাপুরুষ হবার সহজ পথ (!) বাঁধা থাকুক। সিদ্ধির পাতা শোধনের নিয়ম বলি। দুধের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। দুধ যখন হালকা সবুজ বর্ণ ধারণ করবে, তখন দুধ ফেলে দিয়ে সিদ্ধি পাতা সংগ্রহ করতে হবে। সেই পাতা ভালোমতো পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে সামান্য ঘিতে ভেজে বোতলে ভরে রেখে দিতে হবে। তৈরি হয়ে গেল ভেষজ গুণসম্পন্ন সিদ্ধি

-শিশুদের তড়কা রোগে খিচুনিতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। দুঃখিত, মাত্রা জানি না।

-হাঁপানিতে, Hay fever- দারুণ কার্যকর।

-হৃদযন্ত্রের সমস্যায়ও এর ব্যবহার আছে।

-কামউত্তেজক হিসেবে সিদ্ধির ভালো নামডাক আছে।

-রাজা-মহারাজাদের বহু নারীর কাছে সান্ত্বনা পাবার জন্যে যেতে হতো। তাদের জন্যে বিশেষভাবে ঘিয়ে ভাজা সিদ্ধি তৈরি করে দিতে হতো। আমরা যেহেতু আমজনতা, রাজাবাদশা নই, সিদ্ধির এই অপূর্ব (?) ভেষজগুণের বিষয়ে আমাদের না জানলেও চলবে।

Tags: গাঁজা, চরস, ভাং, সিদ্ধি, বৃক্ষের কথা, হুমায়ূন আহমেদ, সিদ্ধির ঔষধি ব্যবহার, গাজার ঔষধি ও ভেষজ ব্যবহার, Gaja, Charas, Bhang, Siddhi, Brikkher Kotha, Humayun Ahmed 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন